বিদ্যা শব্দের আবিধানিক অর্থ অধ্যয়নজনিত জ্ঞান। সাধারণ অর্থে জ্ঞান বলতে বুঝায় বোধ, বুদ্ধি, অনুভব শক্তি, বোঝার বা বিচার করার ক্ষমতা। জ্ঞান আছে এমন ব্যক্তিকে বলা হয় জ্ঞানী। যে ব্যক্তি প্রকৃতি প্রাপ্ত বই, পুস্তক, পুঁথি ও শাস্ত্র পাঠ করে জ্ঞান লাভ করেন তাকে বলে শাস্ত্রজ্ঞ। বেদ যিনি ভালোরূপে বোঝেন বা জানেন তাকে বলে প-িত বা বেদজ্ঞ। আর যিনি ব্রহ্ম, আত্মা, পরমাত্মা ইত্যাদি ঈশ্বরতত্ত্ব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন তাকে বলা হয় পরমাত্মিক জ্ঞানী বা তত্ত্বজ্ঞ।
জ্ঞান সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন মান শূন্যতা, দম্ভহীনতা, অহিংসা, সহিষ্ণুতা, সরলতা, সদগুরুর সেবা, শৌচ, আত্মসংযম, ইন্দ্রিয় বিষয়ে বিরক্তি, অহংকার, জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধিকে দুঃখ হিসেবে দেখা, পুত্র-স্ত্রী-গৃহের প্রতি আসক্তি রহিত হয়ে নিত্যের (ঈশ্বরের) প্রতি মনোনিবেশ করা, বঞ্চিত ও অবাঞ্ছিত বস্তু প্রাপ্তিতে সমভাবাপন্ন, জনবহুল স্থান বর্জন, নির্মল স্থান প্রিয়তা ও অনন্য নিষ্ঠা ও অপ্রতিহতা ভক্তির মাধ্যমে আমার সেবা করার নামই জ্ঞান। আর এ নিত্য, আধ্যাত্ম ও তত্ত্বজ্ঞান যিনি অনুসন্ধান করেন তিনিই জ্ঞানী। বাকিরা অজ্ঞানী। এতে স্পষ্ট যে, যে বিদ্যা আধ্যাত্ম, পারমাত্মিক, বা ঐশ্বরিক জ্ঞান দান করে না তা বিদ্যা নয়, অবিদ্যা।
অবিদ্যা শব্দের আবিধানিক অর্থ অজ্ঞান বা মায়া। মায়া ঈশ্বরের ছায়া, তবে ঈশ্বর থেকে পৃথক নয়। যেমন- একজন মানুষের ছায়া তার থেকে পৃথক নয়। এটা ওই মানুষটির প্রতিবিম্ব যা তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে এবং দেখতে উল্টো দেখায়। তাই একটি ছায়া দেখে তার সংশ্লিষ্ট মানুষটিকে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। ছায়া মরীচিকার ন্যায় মায়ারূপ এক প্রতিবিম্ব, আদর্শ রূপ নয়। ময়লা থাকলে যেমন আয়নাতে নিজের রূপ দেখা যায় না, ঠিক তেমনি মায়ায় আচ্ছন্ন ব্যক্তি ঈশ্বরের স্বরূপ দেখতে পায় না। এ মায়া বা অবিদ্যা পাঁচ প্রকার। যথা- তম, মোহ, মহামোহ, তামিস্র ও অন্ধতামিস্র।
তম: সত্ত্ব, রজ, তম এ তিনটি প্রকৃতিগত গুণ থেকে তম সবচেয়ে নিকৃষ্টতম। তম গুণ সম্পন্ন ব্যক্তিরা প্রমাদ (ভ্রান্তি বা বিমূঢ়তা) আলস্য ও নিদ্রা দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে। তাই তারা কখনই ঈশ্বরকে জানতে পারে না।
মোহ : প্রাকৃতিক জিনিসের প্রতি প্রবল আসক্ত থাকার নাম মোহ।
মহামোহ : প্রত্যাশিত জিনিসটি না পাওয়া পর্যন্ত আসক্তি, পুনঃপুনঃ বৃদ্ধির নাম মহামোহ।
তামিস্র : আবিধানিক অর্থে যে ক্রোধ জন্মায় তাকে তামিস্র বলে। শাস্ত্র মতে এটি একটি নরক বিশেষ। নিশাচর বা দুঃখের স্থান।
অন্ধতামিস্্র : নিবিড় অন্ধকার। এটি একটি ঘোর নরক বিশেষ। অত্যন্ত দুঃখের স্থান।
এ পাঁচ প্রকার অবিদ্যা প্রকৃতিজাত। তাই অবিদ্যার আরেক নাম প্রকৃতি। এই প্রকৃতি ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং অনাদি। সব বিকার এবং গুণ প্রকৃতি থেকে জন্ম। তাই এ প্রকৃতি বা অবিদ্যা এক মায়ারূপ বন্ধন যার অবস্থান ঈশ্বর ও মানুষের মাঝখানে। এটি একটি অস্বচ্ছ পর্দাও বটে যার কারণে মানুষ ঈশ্বরকে দেখতে না পেয়ে মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে ভুল পথে চলে। তারা ক্রমশ অন্ধকার থেকে অন্ধকার জগতে প্রবেশ করতে করতে শেষ পর্যন্ত নীচকুলে (পশু-পাখির যোনিতে) জন্ম গ্রহণ করে।
ত্রৈবিদ্যা বলতে ঋক, সাম, যজু নামক তিনটি বেদকে বুঝায়। যে ব্রাহ্মণ এই তিনটি বেদ অধ্যয়ন করেছেন তাকে বলা হয় ত্রিবেদি। যারা এ তিনটি বেদ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত তারা মনুষ্য সমাজে সম্মান ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। দুর্ভাগ্যবশত: বেদের অনেক বড় বড় পন্ডিতরা বৈদিক জ্ঞানের প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেন না। তাই তারা কেবল আনুষ্ঠানিকতাবশত বেদ অধ্যায়ন করেন এবং ইন্দ্র, চন্দ্র, আদি দেবতাদের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করার প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয়। তাই বেদান্ত সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন- ‘আমিই হলাম ত্রিবেদিদের একমাত্র লক্ষ্য।’ তাই যথার্থ ত্রিবেদি শ্রীকৃষ্ণের চরণারবিন্দের শরণাগত হন এবং তার প্রীতি উৎপাদনের জন্য বিশুদ্ধ ভক্তিযোগে নিয়োজিত থাকেন। এ ভক্তিযোগ শুরু হয় হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন ও কৃষ্ণতত্ত্ব জানার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। যথার্থ ত্রিবেদিরা জানেন হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রই অর্থাৎ নামযজ্ঞই হচ্ছে সব যজ্ঞের শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ এবং একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পুরুষোত্তম। তাই তাকে জানার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানব জীবনের পরম সার্থকতা।
ঈশ্বর নিরাকার। তিনি যখন নিরাকার, তখন তাকে বলা হয় ব্রহ্ম। ব্রহ্ম সব জীব জগতের উপর প্রভূত্ব করেন। তাই ব্রহ্মের আরেক নাম ঈশ্বর। ঈশ্বর শব্দটির মানে হচ্ছে প্রভূ। এ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর যখন আমাদের কৃপা করেন, জগতের মঙ্গল করেন, তখন তাকে বলা হয় ভগবান।
ব্রহ্ম সব প্রাণের উৎস স্বরূপ। তার থেকেই জগতের সৃষ্টি। তার মধ্যেই জগতের অবস্থান। আবার তিনিই আত্মারূপে জীবের মধ্যে অবস্থান করেন। তাই ধর্মগ্রন্থ উপনিষদে বলা হয়েছে ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম।’ অর্থাৎ সবকিছু ব্রহ্ম বা ঈশ্বর।
সুতরাং ব্রহ্ম, ঈশ্বর, ভগবান দেব-দেবী এবং আত্মা আলাদা কিছু নয়। একই ঈশ্বরের ভিন্ন নাম ও পরিচয়। তাই শুধু দেব-দেবী কেন জীবকে সেবা করলেও ঈশ্বরের সেবা করা হয়।
নিরাকার হলেও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যে কোন আকার ধারণ করতে পারেন। তাই তিনি সাকারও। ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন গুণ বা শক্তি যখন ভিন্ন ভিন্ন আকার লাভ করে তখনই তাকে বলা হয় দেব-দেবী। এককথায় ঈশ্বরের সাকার রূপই হচ্ছে দেব-দেবী। ঈশ্বরের বিদ্যা, জ্ঞান ও ধী শক্তির সাকার রূপই হলো সরস্বতী। তাই সরস্বতী বিদ্যার দেবী। তিনি সবাইকে বিদ্যা দান করেন।
দেবী সরস্বতী যে বিদ্যা দান করেন তা ঈশ্বরেরই একটি গুণ। বেদ, পুরান প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থে দেব-দেবীর পূজা করার পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। তাই বৈদিক মতে দেব-দেবীর পূজা করলে তারা সন্তুষ্ট হন। দেব-দেবীরা সন্তুষ্ট হলে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হন। সুতরাং দেব-দেবীর পূজার মাধ্যমে ঈশ্বরেরই পূজা করা হয়।
প্রতি বছর মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে পূজার মাধ্যমে আমরা সরস্বতী দেবীকে আহ্বান করি। স্তবস্তুতির মাধ্যমে তার প্রশংসা করি। তার কাছে কাম্য বস্তু অর্থাৎ বিদ্যা প্রার্থনা করি-
‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহি নমহস্তুতো’
হে মহাভাগ সরস্বতী, বিদ্যাদেবী কমলনয়না, বিশ্বরূপা, বিশালাক্ষী আমাকে বিদ্যা দাও। তোমাকে নমস্কার।
বিদ্যাহীন ও জ্ঞানহীন ব্যক্তিরা মায়ামুখী। তাই তারা ঈশ্বর বিদ্বেষী। তারা ঈশরকে ভুলে গিয়ে মহামোহে আচ্ছন্ন হয়ে ঘোর নরকে প্রবেশ করে। কোনকালেই তারা ঈশ্বরকে পায় না।
হে মা সরস্বতী আমাদের বিদ্যা দান কর। আমরা যেন অহৈতুকী সেবার মাধ্যমে ঈশ্বরের পরম ভক্ত হতে পারি। এ শুভলগ্নে তোমার কাছে এই একমাত্র মিনতি। কৃপা কর, দয়া কর মা এ অধম সন্তানদের। তোমর চরণে পুনঃপুনঃ অগণিত প্রণাম।
বিশ্বজিত পাল..
No comments:
Post a Comment