উত্তরঃগায়ত্রী হিন্দু ধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ পবিত্র মন্ত্র । মন্ত্রের সঠিক তাৎপর্য একমাত্র সাধক ঋষি পুরুষের পক্ষেই বলা সম্ভব ।তারপরও সাধারণ সরল দৃষ্টি নিয়ে মহাত্মা আচার্যদের উপদেশ স্মরণে রেখে, যতটুকু পারা যায় আমরা গায়ত্রী মন্ত্র সম্পর্কে জানব। প্রথমে এর অনুবাদ ও অবস্থানের দিকে নজর দেয়া যাক।
ওঁ ভূভবঃ স্বঃ তৎসবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি ।
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াতৎ ।।ওঁ।।
ঋগ্বেদ, ৩/৬২/১০, যজুর্বেদ, ৩/৩৫, ৩০/২, সামবেদ উত্তরার্চিক, ৬/৩/১০অনুবাদ :
যিনি ত্রিলোকের স্রষ্টা অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব জগতের প্রসবিতা, সেই সচ্চিদানন্দঘন পরমব্রহ্মের বরণীয় জ্যোতিকে আমরা ধ্যান করি । তিনি আমাদের মন ও বুদ্ধিকে শুভ কার্যে প্রেরণা দান করুন।
তাত্পর্যে বলা যায় ভূ ভুবঃ স্বঃ অর্থাৎ পৃথিবী, অন্তরীক্ষ, বিশ্বব্রহ্মণ্ডে, এবং সর্বত্র সেই পরমপুরুষ পরমেশ্বরের প্রভাব বা জ্যোতি বিদ্যমান । তাঁকে ঘিরেই আমাদের জন্ম, মৃত্যু, জীবন সব। তাই তাঁর কাছে আমাদের প্রার্থনা তিনি যেন আমাদের জীবনকে সাত্ত্বিক ভাবে অতিবাহিত করার জন্যে কৃপা করেন । ঋক, সাম, যজু এই তিন বেদেই আমারা মন্ত্রটি পাই যথাক্রমে ঋকবেদ ৩/৬২/১০ যজুবের্দ ৩/৩৫,৩০/২ সামবেদ উত্তর আর্চিক ৬/৩/১০। এই মন্ত্রের দেবতা সবিতা । দ্রষ্টা ঋষি বিশ্বামিত্র, ছন্দ গায়ত্রী এবং এটাই বেদের সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র এবং ছন্দ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতার বিভূতিযোগে ৩৫নং শ্লোকে বলেছেন ছন্দ সমূহের মধ্যে আমি গায়ত্রী। এই হল অতি সংক্ষেপে গায়ত্রী মন্ত্রের বর্ণনা ।
আরও একটি ব্যাপার আমরা দেখব, সেটি হল সূর্য আর সবিতা। যেহেতু সূর্য সবিতা সমার্থক, তাই অনেকে এই মন্ত্রের ক্ষেত্রও সূর্য সবিতা এক করে ফেলেন । নিম্নে আমরা সেটির বিশ্লেষণ দেখব।
বেদে সূর্যের বিভিন্ন নাম আমরা পাই যেমন: সূর্য, পুষা, মিত্র, সবিতা, অর্য্যমা, বিষ্ণু ইত্যাদি এরা সবাই আদিত্য। আমরা দেখছি যে সূর্যের সমার্থক শব্দ সবিতা। সূর্যকে বৈদিক ঋষিরা এই বিশ্বচরাচরের সকল শক্তির উত্স হিসাবে চিন্তা করতেন। বাস্তবেও অবশ্য তাই, আমরা সূর্য শক্তিতেই বলিয়ান। কিন্তু এই মন্ত্রে সবিতা সরাসরি সূর্যের সমার্থক শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়নি। বেদভাষ্যকার সায়নাচার্য এখানে সূর্য ও সবিতার দুই রকম অর্থ করেছেন। এই মন্ত্রে সবিতা হল, সকল কারণের কারণ সেই সচ্চিদানন্দ নিরাকার পরম ব্রহ্ম। তাই সবিতা অর্থ জগত স্রষ্টা। “সু” ধাতু থেকে সবিতৃ নিষ্পন্ন হয়েছে। যার জন্যে সবিতা মানে প্রসবিতা ।
নিরূক্তিকার যাস্ক অর্থ করেছেন “সর্ব্বস্য প্রসবিতা”। বেদ ভাষ্যে সায়ন ব্যাখ্যা করেছেন তত্সবিতুঃ = জগত্প্রসবিতুঃ = বাংলা হচ্ছে নিখিল বিশ্বের সৃষ্টিকারী। তাই এই মন্ত্রে আমরা সেই পরমেশ্বরের বরণীয় জ্যোতিকে ধ্যান করছি। যাকে এখানে সবিতা বলা হয়েছে বা নাম দেওয়া হয়েছে ।
ঋকবেদের ২য় মণ্ডলের ৩৮ সূক্তের ৭ থেকে ১১ নং মন্ত্রে সবিতাকে সকল শক্তির উত্স বলে তার স্তুতি করা হয়েছে।
বলা হয়েছে :
হে সবিতা, তুমি সকল কিছু সৃষ্টি করেছ অন্তরীক্ষ, জল, স্থল। তুমি সকল ভূত, পশুপাখি, স্থাবর জঙ্গম ইত্যাদিকে স্ব স্ব স্থানে রেখেছ। ইন্দ্র,বরুণ, মিত্র, অর্য্যমা, বা রুদ্র সবাই তোমার শক্তিতে বলিয়ান । কেউ তোমাকে হিংসা করে না। হে সবিতা (পরমেশ্বর) তোমার দ্যূতিমান জ্যোতিকে (অর্থ্যাৎ, সকল প্রকাশ যুক্ত শক্তি এবং অপ্রকাশিত অতিন্দ্রিয় শক্তিকে) আমরা নমষ্কার করি। তুমি সকলের কল্যাণ কর। আমাদের জন্যে যেন সকল কিছু শুভ হয় ।[শুধু অনুবাদ দেয়া হল ]
এটাই এই গায়ত্রী মন্ত্রের দেবতা সবিতার তাত্পর্য।
উল্লেখ্য, এই মন্ত্রে সবিতার জ্যোতি মানে সরাসরি সূর্যের জ্যোতি এই অর্থে ব্যবহৃত হয় নাই। হঠাৎ করে মন্ত্রটি দেখলে এটা মনে হতে পারে । তাই এটা বুঝতে আমাদের এর পিছনের বিষয়গুলোকেও দেখতে হবে। বেদে এক জায়গায় সবিতাকে প্রজাপতি অর্থ্যাৎ সমগ্র ভুতগণের সৃষ্টিকারি বলা হয়েছে। তাই এখানে সূর্যের আলো না বুঝে পরমশ্বরের প্রভাবকে বুঝতে হবে।
No comments:
Post a Comment