Hare Krishna

Hare Krishna
Welcome to ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ

শ্রীমদ্ভগবদগীতা- কালীপ্রসন্ন সিংহ

গীতা – প্রথম অধ্যায় – সৈন্যদর্শন
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! কৌরব ও পাণ্ডবগণ সংগ্রামভিলাষে ধর্মভূমি কুরুক্ষেত্রে সমবেত হইয়া কি করিয়াছিল?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! রাজা দুর্য্যোধন পাণ্ডবসৈন্য ব্যূহিত অবলোকন করিয়া দ্রোণাচার্য্য-সমীপে গমনপূর্বক কহিলেন, “আচার্য্য! ঐ দেখুন, আপনার শিষ্য ধীমান ধৃষ্টদ্যুম মহতী পাণ্ডবসেনা ব্যূহিত করিয়াছে। যুযুধান, বিরাট, মহারথ দ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, বীর্য্যবান্ কাশিরাজ, পুরুজিৎ কুন্তীভোজ, নরোত্তম শৈব্য, বিক্রমশালী যুধামন্যু, বীর উত্তমৌজা, অভিমন্যু অ মহারথ দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, এই সকল শৌর্য্যশালী, মহারথ, ভীমার্জুন সমকক্ষ, মহাধনুর্দ্ধর বীরপুরুষগণ ঐ ব্যূহিত সেনামধ্যে সন্নিবিষ্ট আছে! আমাদিগের যে সকল প্রধান সেনানায়ক আছেন, আপনাকে অবগত করাইবার নিমিত্ত তাঁহাদিগের নামও কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। আপনি, ভীষ্ম, কর্ণ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সমদত্তপুত্র ভুরিশ্রবা ও জয়দ্রথ এবং অন্যান্য নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্রসম্পন্ন যুদ্ধবিশারদ বীরপুরুষগণ আমার নিমিত্ত প্রাণদানে অধ্যবসায়ারূঢ় (উদ্যত) হইয়াছেন। আমাদিগের এই ভীষ্মপালিত সৈন্য অপরিমিত (অধিক হইলেও অল্প কার্য্যক্ষম); কিন্তু ভীমরক্ষিত পাণ্ডবসেনা পরিমিত (অপেক্ষাকৃত অল্প হলেও অধিক কার্য্যক্ষম)। এক্ষণে আপনারা সকলে স্ব স্ব বিভাগানুসারে সমুদয় ব্যূহদ্বারে অবস্থানপূর্বক পিতামহ ভীষ্মকে রক্ষা করুন।’
“তখন প্রতাপবান্ কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম রাজা দুর্য্যোধনের হর্ষবর্দ্ধনার্থ সিংহনাদ সহকারে উচ্চস্বরে শঙ্খধ্বনি করিলেন। পরক্ষণেই শঙ্খ, ভেরী, পণব, আনক ও গোমুখ (গোয়ুখাকৃতি শঙ্খসদৃশ বাদ্য) সকল আহত (বাদিত) এবং তাহা হইতে তুমুল শব্দ প্রাদুর্ভূত হইল।
“এদিকে কৃষ্ণ ও অর্জুন শ্বেতাঙ্গযুক্ত রথে সমারহ হইলেন এবং বাসুদেব পাঞ্চজন্য শঙ্খ, অর্জুন দেবদত্ত শঙ্খ, ভীমকর্মা ভীমসেন পৌণ্ড্র নামে মহাশঙ্খ, রাজা যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় শঙ্খ, নকুল সুঘোষ শঙ্খ, সহদেব মণিপুষ্পক শঙ্খ এবং কাশিরাজ শিখণ্ডী, মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদেয়গণ ও অভিমন্যু–ইঁহারা সকলে পৃথক পৃথক শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। এই তুমুল শব্দ ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল প্রতিধ্বনিত করিয়া ধার্ত্ত্রাষ্ট্রগণের হৃদয় বিদারিত করিল।
“হে রাজন! অনন্তর ধনঞ্জয় এই সমারদ্ধ যুদ্ধে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের যথাযোগ্যরূপে অবস্থিত দেখিয়া নিজে শরাসন উত্তোলনপূর্বক বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে অচ্যুত! উভয়ে সেনার মধ্যস্থলে রথ স্থাপন কর; দুর্বুদ্ধি দুর্য্যোধনের প্রিয়াচরণবাসনায় যে সকল ব্যক্তি আগমন করিয়াছেন, তাহাদিগের মধ্যে কাহারা যুদ্ধ করিবেন, আমাকে কাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে হইবে এবং কে যোদ্ধুকাম (যুদ্ধাভিলাষী) হইয়া অবস্থান করিতেছেন, তাঁহাদিগকে নিরীক্ষণ করিব’।” সঞ্জয় কহিলেন, “হে ভারত! অর্জুনের এই কথা শুনিয়া হৃষীকেশ উভয় সেনার মধ্যস্থলে ভীষ্ম, দ্রোণ ও সমস্ত নৃপতিগণের সম্মুখে রথস্থাপন করিয়া কহিলেন, ‘হে পার্থ! ঐ সমস্ত কৌরবগণ সমবেত হইয়াছেন, অবলোকন কর।’
অর্জুনবিষাদ
“ধনঞ্জয় উভয় সেনার মধ্যে তাঁহার পিতৃব্য (পিতার সহোদয় বা জ্ঞাতি ভ্রাতা–জ্যাঠা-খুড়া), পিতামহ, আচার্য্য (গুরু–অস্ত্রগুরু), মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, সখা (সহচর–মিত্র), শ্বশুর ও মিত্রগণ অবস্থান করিতেছেন দেখিলেন। অর্জুন সেই সমস্ত বন্ধুগণকে অবলোকন করিবামাত্র কারুণ্যরসবশংবদ (করুণার বশবর্তী) ও বিষণ্ণ হইয়া বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে মধুসূদন! এই সমস্ত আত্মীয়গণ যুদ্ধার্থী হইয়া আগমন করিয়াছেন দেখিয়া আমার শরীর অবসন্ন, কম্পিত ও রোমাঞ্চিত হইতেছে; মুখ শুষ্ক হইয়া যাইতেছে; গাণ্ডীব হস্ত হইতে স্রস্ত (স্খলিত) হইয়া পতিত হইতেছে; সমুদয় ত্বক দগ্ধ হইতেছে; আমার আর অবস্থান করিবার সামর্থ নাই; চিত্ত যেন উদভ্রান্ত (অত্যন্ত বিচলিত) হইতেছে; আমি কেবল দুর্নিমিত্তই নিরীক্ষণ করিতেছি। এই সমস্ত আত্নীয়গণকে নিহত করা শ্রেয়স্কর (মঙ্গলজনক) বোধ হইতেছে না। হে কৃষ্ণ! আমি আর জয়, রাজ্য ও সুখের আকাঙ্খা করি না। যাঁহাদিগের নিমিত্ত রাজ্য, ভোগ ও সুখের কামনা করিতে হয়, সেই আচার্য্য, পিতা, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক ও সম্বন্ধিগণ সকলেই এই যুদ্ধে জীবন ও ধন পরিত্যাগে কৃতসঙ্কল্প হইয়া অবস্থান করিতেছেন; তবে আমাদিগের আর রাজ্য, ধন ও জীবনে প্রয়োজন কি? ইঁহারা আমাদিগকে বধ কইলেও আমি ইঁহাদিগকে বিনাশ করিতে ইচ্ছা করি না; পৃথিবীর কথা দূরে থাকুক,ত্রৈলোক্যরাজ্য লাভ হইলেও আমি ইঁহাদিগকে বিনাশ করিতে ইচ্ছা করি না। হে জনার্দ্দন! ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগকে নিহত করিলে আমাদিগের কী প্রীতি হইবে? এই আততায়ীদিগকে বিনাশ করিলে আমাদিগকেই পাপভাগী হইতে হইবে; অতএব সবান্ধবে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে বধ করা কোনক্রমেই আমাদিগের কর্তব্য নহে। হে মাধব! আত্মীয়গণকে বিনাশ করিয়া আমরা কী প্রকারে সুখী হইব? ইহাদিগের চিত্ত লোভ দ্বারা অভিভূত হইয়াছে বলিয়া ইহারাই যেন কুলক্ষয়জনিত দোষ ও মিত্রদ্রোহজনিত (বান্ধবহিংসাজনিত) পাতক দেখিতেছে না; কিন্তু আমরা কুলক্ষয়ের দোষ দর্শন করিয়াও কি নিমিত্ত এই পাপবুদ্ধি হইতে নিবৃত্ত হইব না? কুলক্ষয় হইলে সনাতন কুলধর্ম বিনষ্ট হয়; কুলধর্ম বিনষ্ট হইলে সমস্ত কুল অধর্মে পরিপূর্ণ হইয়া উঠে; কুল অধর্মপূর্ণ হইলে কুলস্ত্রীগণ ব্যভিচার দোষে দূষিত হয়; কুলস্ত্রীগণ দূষিত হইলে বর্ণশঙ্কর (নীচজাতি) সমুৎপন্ন হয়; এই বর্ণশঙ্কর কুল ও কুলনাশকদিগকে নিরয়গামী (নরকগামী) করে; কুলনাশকদিগের পিতৃগণের পিণ্ড ও উদকক্রিয়া (শ্রাদ্ধতর্পণাদি) বিলুপ্ত হয়; সুতরাং তাঁহারা পতিত হইয়া থাকেন। কুলনাশক ব্যক্তিদিগের বর্ণসঙ্করের হেতুভূত এই সমস্ত দোষে জাতিধর্ম ও সনাতন কুলধর্ম বিনষ্ট হইলে মনুষ্যগণকে চিরকাল নরকে বাস করিতে হয়। হা! কি কষ্ট! আমরা এই মহাপাপের অনুষ্ঠানে অধ্যবসায়ারূঢ় হইয়া রাজ্যসুখের লোভে আত্মীয়দিগকে বিনাশ করিতে উদ্যত হইয়াছি। আমি প্রতীকারপরাঙ্মুখ (প্রতিবিধানে পশ্চাৎপদ) ও শস্ত্রহীন হইলে যদি রাজ্যসুখলোভে স্বজনবিনাশসমুদ্যত শস্ত্রপাণি (শস্ত্রধারী) ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ আমাকে যুদ্ধে বিনাশ করে, তাহাও আমার কল্যাণকর হইবে’।” সঞ্জয় কহিলেন, “ধনঞ্জয় এইরূপ কহিয়া শর ও শরাসন
পরিত্যাগপূর্ব্বক শোকাকুলিতচিত্তে রথে উপবেশন করিলেন।”

দ্বিতীয় অধ্যায় – বিষাদনাশক সাংখ্যযোগ
সঞ্জয় কহিলেন, “ভগবান্, বাসুদেব কৃপাবশংবদ, অশ্রুপূর্ণলোচন, বিষন্নবদন অর্জুনকে কহিলেন, ‘অর্জুন! ঈদৃশ বিষম সময়ে কি নিমিত্ত তোমার এই অনার্য্যসেবিত, স্বর্গপ্রতিরোধক (স্বর্গগমনে বাধাজনক), অকীর্তিকর মোহ উপস্থিত হইল? হে পার্থ! তুমি ক্লীবতা (কাপুরুষতা–দৌর্বল্য) অবলম্বন করিও না; ইহা তোমার উপযুক্ত নয়। হে পরন্তপ! অতিতুচ্ছ হৃদয়দৌর্বল্য দূরীভূত করিয়া উত্থিত হও।’
“অর্জুন কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি কী প্রকারে পূজনীয় ভীষ্ম ও দ্রোণের সহিত শরজাল দ্বারা প্রতিযুদ্ধ করিব? মহানুভব গুরুজনদিগকে বধ না করিয়া যদি ইহলোকে ভিক্ষান্ন ভোজন করিতে হয়, তাহাও শ্রেয়ঃ; কিন্তু ইহাদিগকে বধ করিলে ইহকালেই রুধিরলিপ্ত অর্থ ও কাম উপভোগ করিতে হইবে। ফলতঃ এই যুদ্ধে জয় ও পরাজয়ের মধ্যে কোন্টির গৌরব অধিক, তাহাও বুঝিতে পারিতেছি না, কেন না, যাঁহাদিগকে বিনষ্ট করিয়া আমরা স্বয়ং জীবিত থাকিতে অভিলাষ করি না, সেই ধার্ত্তরাষ্ট্রগণই সম্মুখে উপস্থিত। কাতরতা ও অবশ্যম্ভাবী কূলক্ষয়জনিত দোষে আমার স্বাভাবিক শৌর্য্যাদি অভিভূত ও আমার চিত্ত ধর্মান্ধ (ধর্মানুরোধে বহির্দৃষ্টিরহিত) হইয়াছে। এই নিমিত্ত তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, যাহা আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর হয় বল, আমি তোমার শিষ্য, তোমার শরণাপন্ন হইয়াছি, আমাকে উপদেশ প্রদান কর। ভূমণ্ডলে অকণ্টক (বাধাবিহীন) সুসমৃদ্ধ রাজ্য ও সুরগণের আধিপত্য প্রাপ্ত হইলেও আমার ইন্দ্রিয়গণ এই শোকে পরিশুষ্ক হইবে। আমি এমন কিছুই দেখিতেছি না, যাহাতে আমার শোকাপনোদ হইতে পারে’।” সঞ্জয় কহিলেন, “অতএব আমি যুদ্ধ করিব না’ শত্রুতাপন গুড়াকেশ (ইন্দ্রিয়জয়ী) অর্জুন হৃষীকেশ-সম্মুখে এই বলিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন।
“হে ভারত! তখন হৃষীকেশ সহাস্য-আস্যে উভয় সেনার মধ্যবর্তী বিষণ্ণবদন অর্জুনকে কহিলেন, ‘হে অর্জুন! তোমার মুখ হইতে পণ্ডিতগণের ন্যায় বাক্য সকল বিনির্গত হইতেছে, অথচ তুমি অশোচ্য বন্ধুগণের নিমিত্ত শোক করিয়া মূর্খতা প্রদর্শন করিতেছ। পণ্ডিতগণ, কি জীবিত, কি মৃত কাহারও নিমিত্ত অনুশোচনা (শোকের অযোগ্য) করে না। আমি পূর্বে যে কখনও ছিলাম না, এমন নহে; এই রাজগণও ছিলেন না, এমন নহে; অতঃপর আমরা সকলে থাকিব না, এমনও নহে। এই দেহ যেমন কৌমার, যৌবন ও জরা প্রাপ্ত হয়, জীবাত্মাও তদ্রূপ দেহান্তর প্রাপ্ত হইয়া থাকেন; ধীরব্যক্তি তদ্বিষয়ে মুগ্ধ হয়েন না। বিষয়ের সহিত ইন্দ্রিয়গণের যে সম্বন্ধ, তাহাই শীত, উষ্ণ ও সুখ-দুঃখের কারণ; সেই সম্বন্ধ কখন উৎপন্ন হয়, কখন বিনষ্ট হয়, অতএব তুমি এই অনিত্য সম্বন্ধ-সকল সহ্য কর। এই সম্বন্ধ-সকল যাঁহাকে ব্যথিত করিতে পারে না, সেই সমদুঃখসুখ (সুখ-সুঃখে তুল্যজ্ঞানী) ধীর পুরুষ মোক্ষলাভের যোগ্য। যাহা কখন ছিল না, যাহা কখন হয় না এবং যাহা বিদ্যমান আছে, তাহারও কখন অভাব হয় না, তত্ত্বদর্শী পণ্ডিতগণ ভাব ও অভাবের এইরূপ নির্ণয় করিয়াছেন। যিনি এই দেহাদিতে ব্যাপ্ত হইয়া আছেন, তাঁহার বিনাশ নাই; কোন ব্যক্তি সেই অব্যয় পুরুষকে বিনাশ করিতে সমর্থ হয় না। হে ভারত! তত্ত্বদর্শীপণ্ডিতগণ কহিয়াছেন, এই সকল শরীর অনিত্য; কিন্তু শরীরী জীবাত্মা নিত্য, অবিনাশী (বিনাশহীন) ও অপ্রেমেয়; অতএব তুমি যুদ্ধ কর। যিনি মনে করেন, এই জীবাত্মা অন্যকে বিনাশ করে এবং যিনি মনে করেন, অন্যে এই জীবাত্মাকে বিনাশ করে, তাঁহারা উভয়েই অনভিজ্ঞ; কেন না, জীবাত্মা কাহাকেও বিনাশ করেন না এবং জীবাত্মাকেও কেহ বিনাশ করিতে পারে না। ইঁহার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই; ইনি পুনঃ পুনঃ উৎপন্ন ও বর্দ্ধিত হয়েন না; ইনি অজ (জন্মরহিত), নিত্য, শাশ্বত (অক্ষয়) ও পুরাণ; শরীর বিনষ্ট হইলে ইনি বিনষ্ট হয়েন না। যে পুরুষ ইঁহাকে অবিনাশী, নিত্য , অজ ও অব্যয় বলিয়া জানেন, তিনি কি কাহাকে বধ করেন, না বধ করিতে আদেশ করেন? যেমন মনুষ্য জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেইরূপ দেহী (আত্মা) জীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করিয়া অভিনব (নূতন) দেহান্তর পরিগ্রহ করেন। ইহা শস্ত্রে ছেদিত (ছিন্ন), অগ্নিতে দগ্ধ, জলে ক্লেদিত (ক্লিণ্ণ–ক্লেদযুদ্ধ) বা বায়ুতে শোষিত (শুষ্ক) হন না। ইনি নিত্য, সর্বগত, স্থিরভাব, অচল ও অনাদি; অতএব অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য ও অশোষ্য। ইনি চক্ষুরাদির অগোচর, মনের অবিষয় (অনুভব) ও কর্মেন্দ্রিয়ের অগ্রাহ্য। অতএব তুমি এই জীবাত্মাকে এবম্প্রকার (এইরূপ) অবগত হইয়া অনুশোচনা পরিত্যাগ কর।
“হে মহাবাহো! যদি জীবাত্মা সর্বদা জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুমুখে প্রবেশ করিয়া থাকেন বলিয়া তাঁহাকে জাত ও মৃত বোধ কর, তাহা হইলে ত ইহার নিমিত্ত শোক করা কর্তব্যই নহে; কেন না, জাত ব্যক্তির মৃত্যু ও মৃত ব্যক্তির জন্ম অবশ্যম্ভাবী ও অপরিহার্য্য; অতএব ঈদৃশ বিষয়ে শোকাকুল হওয়া তোমার উচিত নয়। ভূতসকল উৎপত্তির পূর্বে অব্যক্ত (অপ্রকাশ) ছিল; ধ্বংসসময়েও অব্যক্ত হইয়া থাকে; কেবল জন্মমরণের অন্তরালসময়ে (মধ্যাবস্থায়–মধ্য সময়ে) প্রকাশিত হয়; অতএব তদ্বিষয়ে পরিবেদনা (শোক) কী? কেহ এই জীবাত্মাকে বিস্ময়ের সহিত বর্ণন করেন, কেহ বিস্ময়ের সহিত শ্রবণ করেন, কেহ শ্রবণ করিয়াও বুঝিতে পারে না। হে ভারত! জীবাত্মা সর্বদা সকলের দেহে অবধ্যরূপে অবস্থান করেন, অতএব কোন প্রাণীর নিমিত্ত শোক করা উচিত নয়।
“তুমি স্বধর্মের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে আর এ প্রকার বিকম্পিত (বিচলিত) হইবে না; ধর্মযুদ্ধ ব্যতীত ক্ষত্রিয়ের আর শ্রেয়স্কর কর্ম নাই। হে পার্থ! যে সকল ক্ষত্রিয় যদৃচ্ছাক্রমে (স্বেচ্ছায়) উপস্থিত অনাবৃত(মুক্ত) স্বর্গদ্বারস্বরূপ ঈদৃশ যুদ্ধ লাভ করে, তাহারাই সুখী। যদি তুমি এই ধর্মযুদ্ধ (ধর্মসঙ্গত যুদ্ধ) না কর, তাহা হইলে স্বধর্ম ও কীর্তি হইতে পরিভ্রষ্ট ও পাপভাগী হইবে; লোকে চিরকাল তোমার অকীর্তি কীর্তন করিবে; সম্ভাবিত (প্রথিতযশা–সম্মানিত) ব্যক্তির অকীর্তি মরণ অপেক্ষাও অধিকতর দুঃসহ। যে সকল মহারথ তোমাকে বহুমান (যথেষ্ট সম্মান) করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগের নিকট তোমার গৌরব থাকিবে না; তাঁহারা মনে করিবেন, তুমি ভয়প্রযুক্ত সংগ্রাম-পরাঙ্মুখ হইয়াছ। তাঁহারা তোমার কত অবক্তব্য কথা কহিবেন এবং তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করিবেন; ইহা অপেক্ষা অধিকরত দুঃখ আর কী আছে? সমরে বিনষ্ট হইলে স্বর্গ প্রাপ্ত হইবে; জয়লাভ করিলে পৃথিবী ভোগ করিবে; অতএব যুদ্ধের নিমিত্ত কৃতনিশ্চয় (কর্তব্য-বিষয়ে) হইয়া উত্থান (উদ্যম) কর; সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ ও জয়-পরাজয় তুল্য জ্ঞান করিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও; তাহা হইলে পাপভাগী হইবে না।
কর্মযোগ প্রশংসা
“হে পার্থ! যে জ্ঞান দ্বারা আত্মতত্ত্ব সম্যক্ প্রকাশিত হয়, তাহা তোমার নিকট কীর্ত্তন করিলাম; এক্ষণে কর্মযোগবিষয়িণী (কর্মযোগসম্পর্কিত) বুদ্ধি অবগত হও; এই বুদ্ধি প্রাপ্ত হইলে তুমি কর্মরূপ বন্ধন হইতে বিমুক্ত হইবে। কর্মযোগের অনুষ্ঠান বিফল হয় না। তাহাতে প্রত্যাবায়ও (পাপ) নাই, ধর্মের অত্যল্প অংশও মহদ্ভয় হইতে পরিত্রাণ করে। হে কুরুনন্দন! কর্মযোগবিষয়ে সংশয়রহিত বুদ্ধি একমাত্র (একাগ্র–একরূপ) হইয়া থাকে; কিন্তু প্রমাণজনিত (বেদোক্ত কর্মকাণ্ডত্মক বিধিনিষেধের অধীন) বিবেকরহিত ব্যক্তিদিগের বুদ্ধি অনন্ত ও বহুশাখাবিশিষ্ট। যাহারা আপাত-মনোহর (বর্তমান রম্য–উপস্থিত উপাদেয়) শ্রবণরমণীয় বাক্যে অনুরক্ত, বহুবিধ ফলপ্রকাশক বেদবাক্যই যাহাদিগের প্রীতিকর, যাহারা স্বর্গাদি ফলসাধন কর্ম ভিন্ন অন্য কিছুই স্বীকার করে না, যাহারা কামপরায়ণ, স্বর্গই যাহাদিগের পরমপুরুষার্থ, জন্ম, কর্ম ও ফলপ্রদ, ভোগ ও ঐশ্বর্য্যলাভের সাধনভূত নানাবিধ ক্রিয়াপ্রকাশক বাক্যে যাহাদিগের চিত্ত অপহৃত হইয়াছে এবং যাহারা ভোগ ও ঐশ্বর্য্যে একান্ত সংসক্ত (অত্যন্ত আসক্ত), সেই বিবেকবিহীন মূঢ় ব্যক্তিদিগের বুদ্ধি সমাধি বিষয়ে সংশয়শূন্য হয় না। হে অর্জুন! বেদসকল সকাম ব্যক্তিদিগের কর্মফল-প্রতিপাদক; অতএব তুমি শীতোষ্ণ ও সুখদুঃখাদি-দ্বন্দ্বসহিষ্ণু (রাগ-বিরাগ সহনশীল) ধৈর্য্যশালী, যোগক্ষেমরহিত ও অপ্রমাদী নইয়া নিষ্কাম হও। যেমন কূপ, বাপী, তড়াগ প্রভৃতি জলাশয়ে যেমন প্রয়োজন সিদ্ধ হয়, একমাত্র মহাহ্রদে সেই সকল প্রয়োজন সম্পন্ন হইয়া থাকে, সেইরূপ সমুদয় বেদে সে সকল কর্মফল বর্ণিত আছে, সংশয়রহিত বুদ্ধিবিশিষ্ট ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ একমাত্র ব্রহ্মে তৎসমুদয়ই প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। কর্মেই তোমার অধিকার হউক, কর্মফলে যেন কামনা না হয়; কর্মফল যেন তোমার প্রবৃত্তির হেতু না হয় এবং কর্মপরিত্যাগে তোমার আসক্তি না হউক। হে ধনঞ্জয়! তুমি আসক্তি পরিত্যাগ পূর্ব্বক একান্ত ঈশ্বরপরায়ণ (ঈশ্বরনিষ্ঠ) হইয়া সিদ্ধি ও অসিদ্ধি উভয়ই তুল্য জ্ঞান করিয়া কর্মসকল অনুষ্ঠান কর, পণ্ডিতেরা সিদ্ধি ও অসিদ্ধি উভয়ের তুল্যজ্ঞানই যোগ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। সংশয়রহিত বুদ্ধি দ্বারা অনুষ্ঠিত কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ; কাম্যকর্মসমুদয় সাতিশয় অপকৃষ্ট (হীন), অতএব তুমি কর্মযোগের অনুষ্ঠান কর; সকাম ব্যক্তিরা অতি দীন। যাঁহার কর্মযোগ বিষয়িণী বুদ্ধি উপস্থিত হয়, তিনি ইহজন্মেই পরমেশ্বরপ্রসাদে সুকৃত ও দুষ্কৃত উভয় পরিত্যাগ করেন। অতএব তুমি কর্মযোগের নিমিত্ত যত্ন কর। ঈশ্বরের আরাধনা দ্বারা বন্ধনহেতু কর্মসকলের মোক্ষসাধনতাসম্পাদক (মুক্তি-সাধনশক্তি সংসাধক) চাতুর্য্যই (নিপূনতাই) যোগ। কর্মযোগবিশিষ্ট মনীষিগণ (বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ) কর্মজনিত ফল পরিত্যাগ করেন; সুতরাং জন্মবন্ধন হইতে বিনির্ম্মুক্ত হইয়া অনাময়পদ (দুঃখাদিরহিতপদ) প্রাপ্ত হয়েন। যখন তোমার বুদ্ধি অতি গহণ (দুস্ত্যজ্য) মোহ হইতে উত্তীর্ণ হইবে, তখন তুমি শ্রোতব্য (শ্রবণযোগ্য) ও শ্রুত বিষয়ে বৈরাগ্য লাভ করিবে; তৎসম্বন্ধে তোমার আর কিছুই জিজ্ঞাস্য থাকিবে না। তোমার বুদ্ধি নানাবিধ বৈদিক ও লৌকিক বিষয়শ্রবণে উদ্ভ্রান্ত হইয়া আছে; যখন উহা বিষয়ান্তরে আকৃষ্ট না হইয়া স্থিরভাবে পরমেশ্বরে অবস্থান করিবে, তখনই তুমি তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিবে।’
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে কেশব! সমাধিস্থ (পরমেশ্বরে নিবিষ্টচিত্ত) স্থিতপ্রজ্ঞ (স্থিরবুদ্ধি) ব্যক্তির লক্ষণ কী? তাঁহার বাক্য, অবস্থান ও গতি কী প্রকার?’
“কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে পার্থ! যিনি সর্বপ্রকার মনোগত কামনা পরিত্যাগ করেন, যাঁহার আত্মা আত্মাতেই সন্তুষ্ট থাকে, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। যিনি দুঃখে অক্ষুব্ধচিত্ত, সুখে স্পৃহাশূন্য এবং অনুরাগ, ভয় ও ক্রোধ-বিবর্জিত, সেই মুনি স্থিতপ্রজ্ঞ। যিনি পুত্র, মিত্র প্রভৃতি সকলের প্রতি স্নেহশূন্য, যিনি অনুকূল বিষয়ে অভিনন্দন (অনুরাগ) ও প্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষ করে না, তাঁহারই প্রজ্ঞা নিশ্চলা ও তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। কূর্ম (কচ্ছপ) যেমন আপন অঙ্গসকল সঙ্কোচন করে (ভিতরের দিকে গুটাইয়া লয়), সেইরূপ যিনি বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়গণকে প্রত্যাহরণ (প্রত্যানয়ন) করেন, তাঁহারই প্রজ্ঞা নিশ্চলা ও তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। যিনি ইন্দ্রিয়দ্বারা বিষয় গ্রহণ না করেন, বিষয়সকল তাঁহার নিকট হইতে নিবৃত্ত হইতে পারে; বিষয়াভিলাষ নিবৃত্ত হয় না; কিন্তু স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি পরমেশ্বরকে দর্শন করিয়া বিষয়বাসনা হইতে বিনির্মুক্ত হইয়া থাকেন। হে কৌন্তেয়! ক্ষোভজনক ইন্দ্রিয়গণ যত্নশীল বিবেকী পুরুষের চিত্তকেও বলপূর্বক হরণ করে; এই নিমিত্ত যোগশীল ব্যক্তি তাহাদিগকে সংযমপূর্বক মৎপরায়ণ (ভগবানে একান্ত নিষ্ঠ) হইয়া থাকিবেন। এইরূপে ইন্দ্রিয়গণ যাঁহার বশীভূত থাকে, তাঁহারই প্রগা নিশ্চলা ও তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। প্রথমে বিষয়চিন্তা, চিন্তা হইতে আসক্তি, আসক্তি হইতে অভিলাষ, অভিলাষ হইতে ক্রোধ, ক্রোধ হইতে মোহ, মোহ হইতে স্মৃতিভ্রংশ, স্মৃতিভ্রংশ হইতে বুদ্ধিনাশ, বুদ্ধিনাশ হইতে বিনাশ উপস্থিত হয়। যিনি আত্মাকে বশীভূত করিয়াছেন, তিনি রাগদ্বেষবর্জ্জিত আত্মপ্রসাদ লাভ করেন, আত্মপ্রসাদ থাকিলে সকল দুঃখ বিনষ্ট হয়। প্রসন্নাত্নার বুদ্ধিই আশু নিশ্চল হইয়া উঠে। অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তির বুদ্ধি নাই; সুতরাং সে চিন্তা করিতেও পারে না; চিন্তা করিতে না পারিলে শান্তি হয় না; শান্তিহীন ব্যক্তির সুখ কোথায়? যে চিত্ত স্বেচ্ছাচারী ইন্দ্রিয়গণের বশীভূত হয়, সেই চিত্ত বায়ু কর্তৃক সমুদ্রে ইতস্ততঃ-বিঘূর্ণিত নৌকার ন্যায় জীবাত্মার বুদ্ধিকে বিষয়ে বিক্ষিপ্ত করে। অতএব হে মহাবাহো! যাঁহার ইন্দ্রিয়গণ বিষয় হইতে নিগৃহীত (সংযমবলে বিমুখ) হইয়াছে, সেই ব্যক্তিরই প্রজ্ঞা নিশ্চলা ও তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। অজ্ঞান-তিমিরাবৃতমতি ব্যক্তিদিগের নিশাস্বরূপ ব্রহ্মনিষ্ঠাতে জিতেন্দ্রিয় যোগিগণ জাগরিত থাকেন এবং প্রাণিগণ যে বিষয়নিষ্ঠাস্বরূপ দিবায় প্রবোধিত থাকে, আত্মতত্ত্বদর্শী যোগীদিগের সেই রাত্রি। (রাত্রিতে নিদ্রা ও দিনে জাগরণ, ইহা লোকের স্বাভাবিক। অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে যাহাদের বুদ্ধি আবৃত, ব্রহ্মনিষ্ঠা তাহাদের পক্ষে রাত্রি, তাহাতে তাহারা নিদ্রিত, সুতরাং দেখিতে পায় না। যোগিগণের তথাবিধ রাত্রি দিবাস্বরূপ হয়, তাহাতে তাঁহারা জাগরিত; সুতরাং দর্শনে সমর্থ। প্রাণিগণ বিষয় নিষ্ঠারূপ দিবাতে জাগরিত–বিষয়ভোগে ব্যাপৃত থাকে; আর আত্মদর্শীরা তাহাতে নিদ্রিত, ভোগবিরত থাকেন।) যেমন নদী-সকল সর্বদা পরিপূর্ণ স্থিরপ্রতিষ্ঠ (চাঞ্চল্য রহিত) সমুদ্রে প্রবেশ করে, ভোগ সকল সেইরূপে যাহাকে আশ্রয় করিয়া লীন হইয়া যায়, তিনিই মোক্ষ লাভ করেন; ভোগার্থী ব্যক্তি তাহা প্রাপ্ত হইতে পারে না। যিনি কামনা-সকল পরিত্যাগপূর্বক নিস্পৃহ, নিরহঙ্কার ও মমতাবিহীন হইয়া ভোগ্য বস্তুসমুদয় উপভোগ করেন, তিনি মুক্তিলাভ করিয়া থাকেন। হে পার্থ! ব্রহ্মজ্ঞাননিষ্ঠা এই প্রকার; ইহা প্রাপ্ত হইলে সংসারে আর মুগ্ধ হইতে হয় না। যিনি চরমসময়েও এই ব্রহ্মজ্ঞাননিষ্ঠায় অবস্থান করেন, তিনিও পরব্রহ্মে লয় প্রাপ্ত হয়েন।’”

তৃতীয় অধ্যায় – কর্মযোগ
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে কেশব! যদি তোমার মতে কর্ম অপেক্ষা জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ হয়, তবে আমাকে এই মারাত্মক কর্মে কী নিমিত্ত নিয়োজিত করিতেছ? তুমি কখন জ্ঞানের, কখন বা কর্মের প্রশংসা করিয়া আমার বুদ্ধিকে মুগ্ধপ্রায় করিতেছ; এক্ষণে যাহাতে আমার শ্রেয়োলাভ হয়, এমন এক পক্ষ নিশ্চয় করিয়া বল।’
“কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে পার্থ! আমি পূর্বেই কহিয়াছি যে, ইহলোকে নিষ্ঠা দুই প্রকার;–এক, শুদ্ধচেতাদিগের (নির্মল হৃদয়) জ্ঞানযোগ; দ্বিতীয়, কর্মযোগীদিগের কর্মযোগ। পুরুষ কর্মানুষ্ঠান না করিলে জ্ঞান প্রাপ্ত হয় না এবং জ্ঞান প্রাপ্ত না হইলে কেবল সন্ন্যাস দ্বারা সিদ্ধি লাভ করিতে পারে না। কেহ যখন কর্ম না করিয়া ক্ষণমাত্র অবস্থান করিতে সমর্থ হয় না; পুরুষ ইচ্ছা না করিলেও প্রাকৃতিক (স্বাভাবিক) গুণসমুদয়ই তাহাকে কর্মে প্রবর্তিত করে। যে ব্যক্তি কর্মেন্দ্রিয়সকলকে সংযম করিয়া মনে মনে ইন্দ্রিয়ের বিষয়সকল স্মরণ করে, সেই মূঢ়াত্মা কপটচারী বলিয়া কথিত হয়। হে অর্জুন! যে ব্যক্তি মনোদ্বারা জ্ঞানেন্দ্রিয়গণকে বশীভূত করিয়া আসক্তি পরিত্যাগপূর্বক কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা কর্মানুষ্ঠান করে, সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ। অতএব তুমি নিয়ত কর্ম অনুষ্ঠান কর; কর্মত্যাগ করিলে শরীরযাত্রা নির্বাহ হইবে না। যে কর্ম বিষ্ণুর উদ্দেশে অনুষ্ঠিত হয় না, লোকে তদ্দ্বারাই বন্ধ হইয়া থাকে; অতএব হে কৌন্তেয়! তুমি আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া বিষ্ণুর উদ্দেশে কর্মানুষ্ঠান কর। পূর্বে প্রজাপতি প্রজাগণকে যজ্ঞের সহিত সৃষ্টি করিয়া বলিয়াছেন,–হে প্রজাগণ! তোমরা যজ্ঞদ্বারা উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত হও; যজ্ঞ তোমাদিগের কামনা পরিপূর্ণ করুক। তোমরা যজ্ঞ দ্বারা দেবগণকে সংবর্দ্ধিত কর; দেবগণও তোমাদিগকে সংবর্দ্ধিত করুক; এইরূপ পরস্পর সংবর্দ্ধিত হইয়া তোমাদিগকে অভিলষিত ভোগ্যসকল প্রদান করিবেন। যে ব্যক্তি দেবগণপ্রদত্ত ভোগ্যসকল তাঁহাদিগকে প্রদান না করিয়া উপভোগ করে, সে চোর। সাধুগণ যজ্ঞাবশিষ্ট ভোজন করিয়া সর্বপ্রকার পাপ হইতে মুক্ত হয়েন; কিন্তু যাহারা কেবল আপনার নিমিত্ত পাক করে, সেই পাপাত্মগণ পাপই ভোজন করিয়া থাকে। প্রাণিগণ অন্ন হইতে, অন্ন পর্জ্জন্য (বারিবর্ষণকারী মেঘ–বৃষ্টি) হইতে, পর্জ্জন্য যজ্ঞ হইতে, যজ্ঞ কর্ম হইতে, কর্ম বেদ হইতে এবং বেদ ব্রহ্ম হইতে সমুদ্ভব হইয়াছে; অতএব সর্বব্যাপী ব্রহ্ম নিয়তই যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন। যে ব্যক্তি ইহলোকে বিষয়াসক্ত হইয়া পূর্বোক্ত প্রকারে প্রবর্তিত কর্মাদি চক্রের অনুবর্তী না হয়, তাহার আয়ু পাপময় ও জীবন বৃথা।
“আত্মাতেই যাঁহার প্রীতি। আত্মাতেই যাঁহার আনন্দ এবং আত্মাতেই যাঁহার সন্তোষ, তাঁহাকে কোন কর্ম অনুষ্ঠান করিতে হয় না; কর্মানুষ্ঠান করিলেও তাঁহার পুণ্য হয় না, কর্ম না কইরলেও তাঁহার পাপ হয় না এবং তাঁহাকে মোক্ষের নিমিত্ত ব্রহ্মা অবধি স্থাবর পর্যন্ত কাহারও আশ্রয় গ্রহণ করিতে হয় না। পুরুষ আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া কর্মানুষ্ঠান করিলে মোক্ষ লাভ করেন; অতএব তুমি আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া কর্মানুষ্ঠান করল জনক প্রভৃতি মহাত্মগণ কর্ম দ্বারাই সিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যাহা আচরণ করেন, ইতর ব্যক্তিরা তাহারই অনুষ্ঠান করিয়া থাকে এবং মান্য (কর্মপ্রবর্তক ও কর্মনিবর্তক যে শাস্ত্রকে প্রমাণরূপে গ্রহণ) করেন, তাহারা তাহারই অনুবর্তী হয়, অতএব তুমি লোকদিগের ধর্মরক্ষণার্থ কর্মানুষ্ঠান কর। দেখ, ত্রিভুবনের মধ্যে আমার অপ্রাপ্য কিছুই নাই; সুতরাং আমার কোন প্রকার কর্তব্যও নাই; তথাপি আমি কর্মানুষ্ঠান করিতেছি। যদি আমি আলস্যহীন হইয়া কখন কর্মানুষ্ঠান না করি, তাহা হইলে সমদুদয় লোকে আমার অনুবর্তী হইবে; অতএব আমি কর্ম না করিলে এই সমস্ত লোক উৎসন্ন হইয়া যাইবে এবং আমিই বর্ণসঙ্কর ও প্রজাগণের মলিনতার হেতু হইব। অতএব মূর্খেরা যেমন ফলপ্রত্যাশী হইয়া কর্ম করে, তদ্রুপ বিদ্বানেরা আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া লোকদিগের ধর্মরক্ষণের নিমিত্ত কর্ম করিয়া থাকেন। বিদ্বান ব্যক্তি কর্মাসক্ত অজ্ঞদিগের বুদ্ধিভেদ উৎপন্ন না করিয়া স্বয়ং সর্বপ্রকার কর্মানুষ্ঠানপূর্বক তাহাদিগকে কর্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত করিবেন। সকল প্রকার কর্মই প্রকৃতির গুণস্বরূপ ইন্দ্রিয়গণ কর্তৃক নিষ্পন্ন হইতেছে; কিন্তু অহঙ্কারবিমূঢ়মতি (অহঙ্কারে মোহাপন্ন) ব্যক্তি আপনাকে ঐ সকল কর্মের কর্তা বলিয়া মনে করিয়া থাকে। ইন্দ্রিয়গণই বিষয়ে প্রবৃত্ত হইতেছে জানিয়া গুণকর্মবিভাগের তত্ত্বজ্ঞ ব্যিক্তি বিষয়ে আসক্ত হয়েন না। যাহারা প্রকৃতির সত্ত্ব প্রভৃতি গুণে সাতিশয় মুগ্ধ হইয়া ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়ের কার্য্যে আসক্ত হয়, সর্ব্বজ্ঞ ব্যক্তি তাদৃশ অল্পদর্শী মন্দমতিদিগকে বিচালিত করিবেন না।
“তুমি আমাতে সমুদয় কর্ম সম্পর্পণ করিয়া, আমি অন্তর্যামী পুরুষের অধীন হইয়া কর্ম করিতেছি, এই রূপ ভাবিয়া, কামনা, মমতা ও শোক পরিত্যাগপূর্বক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। যাহারা শ্রদ্ধাবান ও অসূয়াশূন্য হইয়া নিরন্তর আমার মতের অনুসরণ করে, তাহারা সকল কর্ম হইতে মুক্ত হয়। যাহারা অসূয়াপরশব হইয়া অনুষ্ঠান না করে, সেই সকল বিবেকশূন্য ব্যক্তি সমুদয় কর্ম ও ব্রহ্মবিষয়ে মুগ্ধ হইয়া বিনাশ প্রাপ্ত হয়। জ্ঞানবান ব্যক্তিও স্বীয় স্বভাবের অনুরূপ কর্ম কইয়া থাকেন; অতএব যখন সকল প্রাণীই স্বভাবের অনুবর্তী, তখন ইন্দ্রিয় নিগ্রহ করিলে কি হইতে পারে? প্রত্যেক ইন্দ্রিয়েরই স্ব স্ব অনুকূল বিষয়ে অনুরাগ ও প্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষ আছে; ঐ উভয়ই মূমূক্ষুর (মুক্তিকামীর) প্রতিবন্ধক (বাধাসৃষ্টিকারক); অতএব উহাদের বশবর্তী হইবে না। সম্যক্ অনুষ্ঠান পরধর্ম অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অঙ্গহীন স্বধর্মও শ্রেষ্ঠ; পরধর্ম অতি ভয়ানক; অতএব স্বধর্মে মরণও শ্রেয়স্কর।’
“অর্জুন কহিনে, ‘হে বাসুদেব! পুরুষ ইচ্ছা না করিলেও কে কাহাকে বলপূর্বক পালাচরণে নিয়োজিত করে?’
“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে অর্জুন! এই কামই ক্রোধরূপে পরিণত, রজোগুণ হইতে সমুৎপন্ন দুষ্পুরণীয় (অনায়াসে যাহার পূরণ হয় না–পর পর আশা আকাঙ্খা বাড়িতেই থাকে। অতি অধিক আহারী ব্যক্তির যেমন পেট কিছুতেই ভরে না) ও অতিশয় উগ্র; ইহাকেই মুক্তপথের বৈরী বলিয়া জানিবে। যেমন ধূম হইতে অগ্নি, মল দ্বারা দর্পণ (আয়না) ও জরায়ু দ্বারা গর্ভ আবৃত তাহকে, সেইরূপ জ্ঞানিগণের চির-বৈরী, দুষ্পূরণীয়, অনলস্বরূপ কাম জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে। ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি ইহার আবির্ভাবস্থান (উৎপত্তিস্থান); এই কাম আশ্রয়ভূত ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করিয়া দেহীকে বিমোহিত করে; হে অর্জুন! অতএব তুমি অগ্রে ইন্দ্রিয়গণকে দমন এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানবিনাশী পাপরূপ কামকে বিনাশ কর; দেহাদি বিষয় অপেক্ষা ইন্দ্রিয়গণ শ্রেষ্ঠ; ইন্দ্রিয়গণ অপেক্ষা মন শ্রেষ্ঠ; মন অপেক্ষা সংশহরহিত বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ; যিনি সেই বুদ্ধি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, তিনিই আত্মা। হে মহাবাহো! তুমি আত্মাকে এইরূপ অবগত হইয়া এবং মনকে সংশয়রহিত বুদ্ধি দ্বারা নিশ্চয় করিয়া কামরূপ দুরাসদ (দুর্জয়) শত্রুকে বিনাশ কর।’”

চতুর্থ অধ্যায় – জ্ঞানযোগ
“ভগবান বলিলেন, ‘আমি পূর্বে আদিত্যকে এই অব্যয়যোগ কহিয়াছিলাম; তৎপরে আদিত্য মনুকে ও মনু ঈক্ষ্বাকুকে কহিয়াছিলেন এবং নিমিপ্রভৃতি রাজর্ষিগণ পরম্পরাগত (পূর্বাপর ধারাবাহিকরূপে আগত) এই যোগবৃত্তান্ত অবগত হইয়াছিলেন, অনন্তর কালক্রমে উহা বিলুপ্ত হইয়াছিল, আজি আমি তোমার নিকটে সেই পুরাতন যোগবৃত্তান্ত কীর্তন করিলাম; তুমি আমার ভক্ত ও সখা; তন্নিমিত্ত আমি তোমাকে এই রহস্য কহিলাম।’
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে কেশব! আদিত্য জন্মগ্রহণ করিলে পর তোমার জন্ম হইয়াছিল; অতএব আমি কী প্রকারে অবগত হইব যে, তুমি অগ্রে তাঁহাকে এই যোগবৃত্তান্ত কহিয়াছিলে?’
“কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে অর্জুন! আমি অনেকবার জন্মগ্রহণ করিয়াছি; তোমরাও বহু জন্ম অতীত হইয়াছে; তুমি তাহার কিছুই জান না; কিন্তু আমি তৎসমুদয়ই অবগত আছি। আমি জন্মরহিত, অনশ্বর (বিনাশরহিত) স্বভাব ও সকলের ঈশ্বর হইয়াও স্বীয় প্রকৃতিকে আশ্রয় করিয়া আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি। যে যে সময়ে ধর্মের বিপ্লব (বিরুদ্ধ ভাবের উদ্ভব) ও ধর্মের প্রাদুর্ভাব হয়, সেই সেই সময়ে আমি আত্মাকে সৃষ্টি করিয়া থাকি। আমি সাধুগণের পরিত্রাণ, অসাধুগণের বিনাশ ও ধর্মের সংস্থাপনের নিমিত্ত যুগে-যুগে জন্মগ্রহণ করি। হে অর্জুন! যিনি আমার এই অলৌকিক জন্ম ও অলৌকিক কর্ম যথাযথ অবগত হইতে পারেন, তিনি শরীর পরিত্যাগ করিয়া আমাকে লাভ করেন; তাঁহাকে পুনরায় জন্মগ্রহণ করিতে হয় না। অনেকে আসক্তি, ভয় ও ক্রোধ পরিত্যাগ করিয়া একাগ্রচিত্ত, একাগ্র আশ্রিত এবং জ্ঞান ও তপস্যা দ্বারা পবিত্র হইয়া আমার সাষুজ্য (সংযোগ–সাম্য) লাভ করিয়াছে। হে পার্থ! যাহারা যেরূপে আমাকে ভজনা করে, আমি তাহাদিগকে সেই প্রকারেই অনুগ্রহ করি। যে যাহা করুক, সকলেই আমার সেবাপথে আগমন করিতেছি। মনুষ্যলোকে অচিরকালেই কর্মসকল সফল হয়; এই নিমিত্ত কর্মফলাকাঙ্খী মনুষ্যেরা প্রায়ই ইহলোকে দেবতার অর্চনা করিয়া থাকে। আমি গুণ ও কর্মের বিভাগানুসারে (ব্রাহ্মণগণের সত্ত্বগুণ অধিক, তাঁহাদের কার্য্য ইন্দ্রিয়দমনপূর্বক যোগতপস্যাদি। রজোবহুল ক্ষত্রিয়গণের কার্য্য যুদ্ধাদি দ্বারা রাজ্যশাসন-পালন। বৈশ্যগণ রজোমিশ্রিত তমঃপ্রধান, তাঁহাদের কার্য্য বানিজ্য ও কৃষি-গোরক্ষাদি। শূদ্র কেবল তমঃপ্রধান, ব্রাহ্মণাদি ত্রিবর্ণের সেবা দ্বারা সাহায্যই তাহাদের কার্য্য। জাতি দেখিয়া গুণকর্মের এইরূপ কল্যাণকর বিভাগ–গুণ দেখিয়া জাতিবিভাগ নহে) ব্রাহ্মণ প্রভৃতি চারি বর্ণ সৃষ্টি করিয়াছি; তথাপি আমি সংসারবিহীন; আমাকে কর্তা মনে করিও না। কর্ম আমাকে স্পর্শ করিতে পারে না; কর্মফলেও আমার স্পৃহা নেই। যে ব্যক্তি আমাকে এইরূপ অবগত হইতে পারে, তাহাকে কর্মবন্ধনে বন্ধ হইতে হয় না। পূর্বতন মুমুক্ষুগণ আমাকে এই প্রকারে অবগত হইয়া কর্ম অনুষ্ঠান করিতেন; অতএব তুম প্রথমে পূর্বতনদিগের অনুষ্ঠিত কর্ম অনুষ্ঠান কর।
“ইহলোকে বিবেকিগণও কর্ম ও অকর্ম-বিষয়ে মোহিত হইয়া আছেন; অতএব তুমি যাহা অবগত হইয়া সংসার হইতে মুক্ত হইবে, আমি তোমাকে সেই কর্মের বিষয় কহিতেছি, শ্রবণ কর। কর্মের গতি অতি দুরবগাহ, অতএব বিহিত কর্ম, অবিহিত কর্ম ও কর্মত্যাগ এই তিনের তত্ত্ব অবগত হইতে হয়; যিনি কর্ম বিদ্যমান থাকিতেও আপনার কর্মশূন্য এবং কর্মত্যাগ হইলেও কর্মযুক্ত বলিয়া বোধ করেন, তিনিই মনুষ্যের মধ্যে বুদ্ধিমান, যোগী এবং সকল কর্মের অনুষ্ঠাতা। যাঁহার সমুদয় কর্ম নিষ্কাম, পণ্ডিতগণ তাঁহাকে পণ্ডিত বলিয়া থাকেন; তাঁহার কর্মসমুদয় জ্ঞানাবলে (জ্ঞানরূপ অগ্নিতে) দগ্ধ হইয়া যায়। যিনি কর্মফলে আসক্তি পরিত্যাগপূর্বক চিরতৃপ্ত হইয়া থাকেন এবং কাহারও আশ্রয় গ্রহণ করেন না, তিনি কর্মে সম্যক্ প্রবৃত্ত হইলেও তাঁহার কিছুমাত্র কর্ম করা হয় না। যিনি কামনা ও সর্বপ্রকার পরিগ্রহ পরিত্যাগ করেন, যাঁহার মন ও আত্মা বিশুদ্ধ, তিনি কেবল শরীর দ্বারা কর্মানুষ্ঠান করিয়া পাপভাগী হয়েন না। যিনি যদৃচ্ছালাভে সন্তুষ্ট, শীত, উষ্ণ ও সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্বসহিষ্ণু ও বৈরবিহীন এবং যিনি সিদ্ধি ও অসিদ্ধি তুল্য জ্ঞান করেন, তিনি কর্ম করিয়াও কর্ম বন্ধনে বদ্ধ হয়েন না। যিনি কামনা পরিত্যাগ করিয়াছেন, রাগাদি হইতে মুক্ত হইয়াছেন এবং যাঁহার চিত্ত জ্ঞানে অবস্থান করিতেছে, তিনি যজ্ঞার্থ কর্মানুষ্ঠান করিলে কর্মসকল বিলয় হইয়া যায়। স্রুক্স্রুবাদি পাত্রসকল ব্রহ্ম; হবনীয় (আহুরিত নিমিত্ত প্রদত্ত) ঘৃতাদি ব্রহ্ম, অগ্নিও ব্রহ্ম ও যিনি হোম করেন, তিনিও ব্রহ্ম; এই প্রকার কর্মস্বরূপ ব্রহ্মে যাঁহার সমাধি হইয়াছে, তিনি ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়েন। কতকগুলি যোগী সম্যক্রূপে দেবযজ্ঞই (দেবতার উদ্দেশ্যে যজ্ঞই) অনুষ্ঠান করেন; কোন কোন যোগী পূর্বোক্ত প্রকারে ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে যজ্ঞরূপ উপায় দ্বারা যজ্ঞাদি কর্মসকল (কর্মত্যাগরূপ) আহুতি প্রদান করিয়া থাকেন; কেহ কেহ সংযমরূপ অগ্নিতে শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়গণকে, আর কেহ কেহ ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদি বিষয় সকল আহুতি দিয়া থাকেন। কেহ কেহ ধ্যেয় বিষয় (পদার্থ) দ্বারা উদ্দীপিত আত্মধ্যানরূপ যোগাগ্নিতে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের কর্ম, কর্মেন্দ্রিয়ের কর্ম ও প্রাণবায়ুর কর্মসকল আহুতি প্রদান করেন। দৃঢ়ব্রত যতিগণ দ্রব্যদান, চান্দ্রায়ণাদি ব্রত, সমাধি, বেদপাঠ ও বেদজ্ঞান, এই কয়েকটি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। কেহ কেহ প্রাণবৃত্তিতে অপানবৃত্তিকে আহুদি প্রদান করিয়া পূরক (নাসিকাপথে অভ্যন্তরে), অপানবৃত্তিতে প্রাণবৃত্তিকে আহুতি প্রদান করিয়া রেচক (অভ্যন্তরে পূরিত বায়ুর নিঃসরণ) এবং প্রাণ ও অপানের গতিরোধ করিয়া কুম্ভকরূপ (অভ্যন্তরে বায়ু রোধক) প্রাণায়াম করেন; আর কেহ কেহ নিয়তাহার (সংযত-আহার) হইয়া প্রাণবৃত্তি সমুদয়কে প্রাণবৃত্তিতেই হোম করিয়া থাকেন। এই সকল যজ্ঞবেত্তা যজ্ঞ দ্বারা নিষ্পাপ হইয়া যজ্ঞশেষরূপ অমৃত ভোজন করিয়া সনাতন ব্রহ্মকে লাভ করেন, কিন্তু যজ্ঞহীন ব্যক্তির পরলোকের কথা দূরে থাকুক, ইহলোকও নাই। এবংবিধ ভূরি ভূরি (বহু বহু) যজ্ঞ বেদ দ্বারা বিস্তারিত হইয়াছে, তৎসমুদয়ই কর্ম হইতে উৎপন্ন; তুমি ইহা অবগত হইয়া মুক্তিলাভ কর। ফলের সহিত সমুদয় কর্ম জ্ঞানের অন্তর্ভূত আছে, অতএব দ্রব্যময় দৈবযজ্ঞ অপেক্ষা জ্ঞানযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ।
“হে ধনঞ্জয়! তুমি প্রণিপাত, প্রশ্ন ও সেবা দ্বারা জ্ঞান শিক্ষা কর, তত্ত্বদর্শী জ্ঞানীরা তোমাকে তাহার উপদেশ প্রদান করিবেন। জ্ঞানলাভ করিলে তুমি আর এ প্রকার বন্ধুবধাদিজনিত মোহে অভিভূত হইবে না, তুমি আপনাকে সমুদয় ভূতকে অভিন্ন অবলোকন করিয়া পরিশেষে পরমাত্মাকে আত্মায় অভিন্ন দেখিবে। যদ্যপি তুমি সকল পাপী অপেক্ষা অধিক পাপী হও, তথাপি সেই জ্ঞানরূপ ভেলা দ্বারা সমস্ত পাপ হইতে উত্তীর্ণ হইবে। হে অর্জুন! যেমন প্রজ্বলিত হুতাশন কাষ্ঠ-সমুদয় ভষ্মাবশেষ করে, সেইরূপ জ্ঞানাগ্নি ন্যায় শুদ্ধিকর আর কিছুই নাই, মুমুক্ষু ব্যক্তি কর্মযোগে সিদ্ধি প্রাপ্ত হইয়া আপনা হইতেই আত্মজ্ঞান লাভ করে। যে ব্যক্তি গুরুর উপদেশ শ্রদ্ধাবান, গুরুশুশ্রূষাপরায়ণ ও জিতেন্দ্রিয়, তিনি জ্ঞান লাভ করিয়া অচিরাৎ (১) মোক্ষপদ প্রাপ্ত হয়েন; কিন্তু জ্ঞান ও শ্রদ্ধাবিহীন সংশয়াত্মা ব্যক্তি বিনাশ প্রাপ্ত হয়, সংশয়াত্মার এই লোক ও পরলোক কিছুই নাই এবং সুখও নাই। হে ধনঞ্জয়! যিনি যোগ দ্বারা কর্মসকল ঈশ্বরে সমর্পণ ও জ্ঞান দ্বারা সংশয়চ্ছেদ করিয়াছেন, কর্মসকল এই অপ্রমত্ত ব্যক্তিকে বদ্ধ করিতে পারে না। অতএব হে ভারত! আত্মজ্ঞানরূপ অসি দ্বারা হৃদয়নিহিত, অজ্ঞানসম্ভূত! সংশয় ছেদ করিয়া কর্মযোগ অনুষ্ঠান কর এবং উত্থিত হও।’”

পঞ্চম অধ্যায় – সন্ন্যাসযোগ
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! তুমি কর্মসন্ন্যাস (কর্মত্যাগ) ও কর্মযোগ (ফলত্যাগপূর্বক কর্মাচরণ) উভয়ের কথাই কহিতেছ, এক্ষণে উভয়ের মধ্যে যাহা শ্রেয়স্কর, তাহা অবধারিত করিয়া বল।’
“কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে অর্জুন! কর্মত্যাগ, কর্মযোগ উভয়ই মুক্তির কারণ, কিন্তু তন্মধ্যে কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ। যাঁহার দ্বেষ নাই ও আকাঙ্খা নাই, তিনিই নিত্য-সন্ন্যাসী, কারণ, তদৃশ নির্দ্বন্ধ পুরুষেরাই অনায়াসে সংসারবন্ধন হইএ মুক্তিলাভ করেন।
মূর্খেরাই সন্ন্যাস ও যোগ উভয়ের ভিন্ন ভিন্ন ফল কহে; কিন্তু পণ্ডিতেরা এরূপ কহেন না; বাস্তবিকও যিনি সন্ন্যাস ও যোগ এই উভয়ের একটিমাত্র সম্যক্ অনুষ্ঠান করেন, তিনি উভয়েরই ফলপ্রাপ্ত হয়েন। সন্ন্যাসীরা মোক্ষনামক যে স্থান লাভ করেন, কর্মযোগীরাও সেই স্থান প্রাপ্ত হয়েন; যিনি সন্ন্যাস ও যোগ উভয়ই একরূপ দেখেন, তিনিই যথার্থদর্শী কিন্তু কর্মযোগযুক্ত ব্যক্তি সন্ন্যাসী হইয়া অচিরাৎ ব্রহ্মলাভ করেন। যিনি যোগযুক্ত হইয়া বিশুদ্ধচিত্ত হয়েন, যাঁহার দেহ ও ইন্দ্রিয়গণ বশীভূত, যাঁহার আশা সকল ভূতের আত্মাস্বরূপ, যিনি লোকযাত্রা নির্বাহার্থ কর্ম অনুষ্ঠান করিলেও তাহাতে লিপ্ত হয়েন না। পরমার্থদর্শী (ব্রহ্মদর্শনকারী) কর্মযোগী দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, ঘ্রাণ, অশন (ভোজন) গমন, শয়ন, আলাপ, ত্যাগ, গ্রহণ, উন্মেষ (চক্ষুর পাতা খোলান) ও নিমেষ (চক্ষুর পাতা বোজান) করিয়াও মনে করেন, আমি কিছুই করিতেছি না, ইন্দ্রিয়গণই স্ব স্ব বিষয়ে প্রবৃত্ত হইতেছে। যিনি আসক্তি পরিত্যাগপূর্বক ব্রহ্মে কর্মফল সমর্পণ কইয়া কর্ম করেন, পদ্মপত্রে জলের ন্যায় তাঁহাতে পাপ লিপ্ত হয় না। কর্মযোগিগণ চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত কর্মফলে আসক্তি পরিত্যাগ করিয়া শরীর, মন, বুদ্ধি ও মমত্ববুদ্ধি (‘আমি’ ‘আমার’ জ্ঞান)-বর্জিত ইন্দ্রিয়দ্বারা কর্মানুষ্ঠান করেন। পরমেশ্বরপরায়ণ ব্যক্তি কর্মফল পরিত্যাগ করিয়া কৈবল্য (কেবল—একরূপতা) প্রাপ্ত হয়েন; কিন্তু ঈশ্বরনিষ্ঠাবিমুখ (ঈশ্বরে বিশ্বাসহীন) ব্যক্তি কামনাবশতঃ ফলপ্রত্যাশী (ফলাকাঙ্খী) হইয়া বদ্ধ হয়। জিতেন্দ্রিয় দেহী (জীবাত্মা) মনে মনে সমুদয় কর্ম পরিত্যাগ করিয়া নবদ্বারবিশিষ্ট দেহপুর সুখে অবস্থান করেন। তিনি স্বয়ং কর্মে প্রবৃত্ত হয়েন না ও অন্যকেও প্রবৃত্ত করেন না। বিশ্বকর্তা (বিশ্বের বিধাতা) ঈশ্বর জীবলোকের কর্তৃত্ব ও কর্মসকল সৃষ্টি করেন না এবং কাহাকেও কর্মফলভোগী করেন না, স্বভাবই তৎসমুদয়ের প্রবর্তক। ঈশ্বর কাহারও পাপ বা পুণ্য গ্রহণ করেন না, জ্ঞান অজ্ঞান আবৃত হয় বলিয়া জীবসকল মোহাবিষ্ট হইয়া থাকে। যাঁহারা জ্ঞানদ্বারা আত্মার অজ্ঞানকে বিনাশিত করিয়াছেন, তাঁহাদিগের ব্রহ্মজ্ঞান আদিত্যের ন্যায় প্রকাশিত হয়। ঈশ্বরে যাঁহাদিগের সংশয়রহিত বুদ্ধি, ঈশ্বরেই যাঁহাদিগের আত্মা, ঈশ্বরেই যাঁহাদিগের নিষ্ঠা এবং ঈশ্বরেই যাঁহাদিগের পরম আশ্রয়, তাঁহারা জ্ঞানদ্বারা নিষ্পাপ হইয়া মোক্ষলাভ করেন।
“ ‘পণ্ডিতগণ বিদ্যা ও বিনয়সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গো, হস্তী, কুক্কুর ও চণ্ডালকে তুল্যরূপে রেখেন। এইরূপ যাঁহাদিগের মন সর্বত্র সমভাবে অবস্থান করেন, তাঁহারাই জীবনাবস্থাতেই সংসার জয় করেন এবং নির্দোষ ব্রহ্ম সর্বত্রই সমভাবে আছেন, সুতরাং সমদর্শী (তুল্যদৃষ্টিসম্পন্ন) ব্যক্তিরাও ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। যিনি ব্রহ্মবিৎ হইয়া ব্রহ্মে অবস্থান করেন, তিনি প্রিয়বস্তু প্রাপ্ত হইয়া হর্ষযুক্ত বা অপ্রিয় বস্তু প্রাপ্ত হইয়া উদ্বিগ্ন হয়েন না; কেননা, তিনি মোহ হইতে মুক্ত হইয়া স্থিরবুদ্ধি লাভ করিয়াছেন। যাঁহার চিত্ত বাহ্যবিষয়ে আসক্ত হয় না, তিনি অন্তঃকরণে শান্তিসুখ অনুভব করেন, পরিশেষে ব্রহ্মে সমাধিলাভ করিয়া অক্ষয় সুখ প্রাপ্ত হয়েন। যেসকল সুখ বিষয় হইতে উৎপন্ন হয়, তাহা দুঃখের কারণ ও বিনশ্বর; পণ্ডিতগণ তাহাতে আসক্ত হয়েন না। যিনি ইহলোকে শরীর পরিত্যাগের পূর্বে কাম ও ক্রোধের বেগ সহ্য করিতে পারেন, তিনিই যোগী ও তিনিই সুখী। আত্মাতেই যাঁহার সুখ, আত্মাতেই যাঁহার আরাম ও আত্মাতেই যাঁহার দৃষ্টি, সেই ব্রহ্মনিষ্ঠ যোগী ব্রহ্মে লয়প্রাপ্ত হয়েন। যাঁহারা পাপকে বিনাশ করিয়াছেন, সংশয়কে ছেদন করিয়াছেন, চিত্তকে বশীভূত করিয়াছেন এবং সকলের হিতানুষ্ঠানে ব্যাপৃত আছেন সেই তত্ত্বদর্শিগণই মোক্ষলাভ করেন। যেসকল সন্নাসী কাম ও ক্রোধ পরিত্যাগ করিয়া চিত্তকে আয়ত্ত্ব করিয়াছেন এবং আত্মতত্ত্ব অবগত হইয়াছেন, তাঁহারা ইহকাল ও পরকাল উভয়ত্রই মোক্ষলাভ করেন। যে মোক্ষপরায়ণ মুনি মন হইতে বাহ্যবিষয়সকল বহিষ্কৃত, নয়নদ্বয় ভ্রুযুগলের মধ্যে সংস্থাপিত, নাসার অভ্যন্তরচারী প্রাণ ও অপানবৃত্তিকে সমভাবাপন্ন করিয়া ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধি বশীভূত এবং ইচ্ছা, ভয় ও ক্রোধ দূরপরাহত (একান্ত ত্যাগ) করিয়াছেন, তিনিই জীবন্মুক্ত। মানবগণ আমাকে যজ্ঞ ও তপস্যার ভোক্তা এবং সকল লোকের মহেশ্বর ও সুবৃহৎ জানিয়া শান্তি লাভ করেন।’ ”

ষষ্ঠ অধ্যায় – ধ্যানযোগ
“‘হে অর্জুন! যিনি ফলে বিতৃষ্ণ (আকাঙ্খারহিত) হইয়া কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান করেন, তিনিই সন্ন্যাসী এবং তিনিই যোগী; কিন্তু যিনি অগ্নিসাধ্য ইষ্ট (যজ্ঞ) ও অনগ্নি পূর্ত প্রভৃতি পরিত্যাগ করিয়াছেন, তিনি সন্ন্যাসীও নহেন যোগীও নহেন। পণ্ডিতেরা যাহা সন্ন্যাস বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন তাহাই যোগ, অতএব কর্মফল পরিত্যাগ না করিলে কেহ যোগী হইতে পারে না। যে মুনি জ্ঞানযোগে আহরণ করিতে ইচ্ছা করেন, কর্মই তাঁহার সহায়, আর যিনি তাহাতে আরোহন করিয়াছেন, কর্মত্যাগই তাঁহার সহায়। যিনি সর্বপ্রকার সঙ্কল্প পরিত্যাগ করিয়া ইন্দ্রিয়ের ভোগ্য ও ভোগসাধন কর্মে আসক্ত না হয়েন, তিনিই তখন যোগারূঢ় বলিয়া উল্লিখহিত হইয়া থাকেন। আত্মা দ্বারা আত্মাকে সংসার হইতে উদ্ধার করিবে, তাহাকে অবসন্ন করিবে না, কারণ, আত্মাই আত্মার বন্ধ এবং আত্মাই আত্মার রিপু। যে আত্মা আত্মাকে জয় করিয়াছে, সেই আত্মাই আত্মার বন্ধু, আর যে আত্মা আত্মাকে জয় করিতে অসমর্থ হইয়াছে, সে আত্মাই শত্রুর ন্যায় আত্মার অপকারে প্রবৃত্ত হয়। শীত, উষ্ণ, সুখ, সুঃখ, মান ও অপমান উপস্থিত হইলে কেবল জিতাত্মা প্রশান্ত ব্যক্তির আত্মাই সাক্ষাৎ আত্মভাব অবলম্বন করে। যাঁহার আত্মা জ্ঞান ও বিজ্ঞানে পরিতৃপ্ত হইয়াছে, যিনি নির্বিকার ও জিতেন্দ্রিয় এবং যিনি লোষ্ট্র (মাটির ডেলা), প্রস্তর ও কাঞ্চন সমজ্ঞান করেন, সেই যোগীই যোগারূঢ় বলিয়া উল্লিখিত। যিনি সুহৃৎ, মিত্র, অরি, উদাসীন, মধ্যস্থ, দ্বেষ্য, বন্ধু, সাধু, সকলকেই সমজ্ঞান করেন, তিনি সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
“যোগী ব্যক্তি নির্জনে নিরন্তন অবস্থান এবং আশা ও পরিগ্রহ পরিত্যাগপূর্বক অন্তঃকরণ ও দেহ বশীভূত করিয়া চিত্তকে সমাধান (সমতাযুক্ত) করিবেন। জিতচিত্ত ও জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি আত্মশুদ্ধির নিমিত্ত একাগ্রমণে পবিত্র স্থানে ক্রমান্বয়ে কুশ, অজিন ও বস্ত্র দ্বারা প্রস্তুত, অনতি-উচ্চ, অনতি-নীচ, স্থিরতর আসন সংস্থাপন করিয়া তাহাতে উপবেশন; শরীর, মস্তক ও গ্রীবা সম ও সরলভাবে ধারণ এবং দৃষ্টিকে অন্যান্য দিক্ হইতে আকর্ষণপূর্বক স্বীয় নাসিকার অগ্রভাবে সন্নিবেশিত করিয়া যোগ অভ্যাস করিবে। যোগী ব্যক্তি প্রশান্তত্মা (স্থির), নির্ভয়, ব্রহ্মচারী, সংযতচিত্ত ও মৎপরায়ণ হইয়া আমাতেই চিত্ত অর্পণপূর্বক অবস্থান করিবে। সংযতচিত্ত যোগী এইরূপে অন্তঃকরণকে সমাহিত করিলে আমার সারূপ্যরূপ (সারূপ্য = রূপতা?–রূপসাম্য) মোক্ষপ্রধান শান্তি লাভ করে। হে অর্জুন! অতিভোজনশীল বা একান্ত অনাহারী এবং অতিনিদ্রালু (অত্যন্ত নিদ্রাসেবী) বা একান্ত নিদ্রাহীন ব্যক্তির সমাধি হয় না। যাঁহার আহার, বিহার, কর্মচেষ্টা, নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মিত, তিনিই দুঃখ-বিনাশক সমাধি লাভ করিতে পারেন। যখন বশীভূত চিত্ত সর্বপ্রকার কাম্যবিষয়ে নিষ্পৃহ হইয়া আত্মাতেই অবস্থান করে, তখনই তাহা সমাহিত (সমাধিস্থ) বলিয়া উল্লিখিত হয়। জিতচিত্ত যোগী ব্যক্তির চিত্ত আত্মযোগানুষ্টানকালে নির্বাত-নিষ্কম্প (বায়ুবিহীন স্থান-স্থিত কম্পনরহিত) দীপের ন্যায় নিশ্চল হইয়া থাকে। যে অবস্থায় চিত্ত যোগানুষ্ঠান দ্বারা নিরুদ্ধ হইয়া উপরত হয়, যে অবস্থায় বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ দ্বারা আত্মাকেই অবলোকন করিয়া আত্মাতেই পরিতৃপ্ত হয়, যে অবস্থায় বুদ্ধিমাত্রলভ্য, অতীন্দ্রিয়, আত্যন্তিক সুখ উপলব্ধি হয়, যে অবস্থায় অবস্থান করিলে আত্মতত্ত্ব হইতে পরিচ্যুত হইতে হয় না, যে অবস্থা লাভ করিলে অন্য লাভকে অধিক বলিয়া বোধ হয় না এবং যে অবস্থা উপস্থিত হইলে গুরুতর দুঃখও বিচলিত করিতে পারে না, সেই অবস্থার নামই যোগ; যাহাতে দুঃখের সম্পর্কও নাই, তাহাই বিশেষরূপে অবগত হইবে এবং অধ্যবসায়সহকারে ও নির্বেদশূন্যচিতে অভ্যাস করিবে। মনকে আত্মাতে নিহিত করিয়া স্থির বুদ্ধি দ্বারা অল্পে অল্পে বিরতি অভ্যাস করিবে; অন্য কিছুই চিন্তা করিবে না। চঞ্চল স্বভাব মন যে যে বিষয়ে বিচরণ করিবে, সেই সেই বুষয় হইতে তাহাকে প্রত্যাহরণ করিয়া আত্মার বশীভূত করিবে। প্রশান্তচিত্ত, রজোবিহীন (মলশূন্য), নিষ্পাপ, জীবন্মুক্ত (জীবিতাবস্থায় মুক্ত–কামনা-বাসনাবিহীন জীবিতাবস্থা) যোগী নিরতিশয় সুখ লাভ করেন। নিষ্পাপ যোগী এই প্রকারে মনকে সর্বদা বশীভূত করিয়া অনায়াসে ব্রহ্মসাক্ষাৎকারজনিত সর্বোৎকৃষ্ট সুখ প্রাপ্ত হয়েন। সর্বত্র ব্রহ্মদর্শী, সমাহিতচিত্ত ব্যক্তি সকল ভূতে আত্মাকে ও আত্মাতে সকল ভূতকে অবলোকন করেন। যে ব্যক্তি আমাতে সকল বস্তু ও সকল বস্তুতে আমাকে দর্শন করে, আমি তাহার অদৃশ্য হই না; সে ব্যক্তিও আমার অদৃশ্য হয় না। যে ব্যক্তি আমার সহিত একীভূত (এক) হইয়া আমাকে সর্বভূতস্থ (সকল প্রাণীতে বিদ্যমান) মনে করিয়া ভজনা করে, সে যে কোন প্রকার বৃত্তি অবলম্বন করুক, আমাতেই অবস্থান করে। হে অর্জুন! যে ব্যক্তি আপনার সুখ-দুঃখের ন্যায় সকলের সুখ-দুঃখ দর্শন করে, সেই শ্রেষ্ঠ যোগী।’
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে মধুসূদন! তুমি আত্মার সমতারূপ যে যোগের কথা উল্লেখ করিলে, মনের চঞ্চলতানিবন্ধন আমি ইহার দীর্ঘকাল স্থায়িত্ব দেখিতেছি না; মন স্বভাবতঃ চঞ্চল, ইন্দ্রিয়গণের ক্ষোভকর, অজেয় ও দুর্ভেদ্য; যেমন বায়ুকে নিরুদ্ধ করা অতি কঠিন, মনকে নিগৃহীত করাও সেইরূপ দুষ্কর বোধ হইতেছে!’
“কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে অর্জুন! চঞ্চলস্বভাব মন যে দুর্নিগ্রহ (বশে আনা দুঃসাধ্য), তাহাতে সংশয় নাই; কিন্তু অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা তাহাকে নিগৃহীত করিতে হয়। যাহার চিত্ত অবশীভূত, যোগ লাভ করা তাহার পক্ষে দুর্ঘট। যে যত্নশীল ব্যক্তি অন্তঃকরণকে বশীভূত করিয়াছে, সে ব্যক্তি যথোক্ত উপায় দ্বারা যোগলাভ করিতে সমর্থ।’
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! যে ব্যক্তি শ্রদ্ধাবান্ কিন্তু যত্নহীন ও যোগভ্রষ্টচেতাঃ (যোগ হইতে স্খলিত চিত্ত), সে যোগসিদ্ধি প্রাপ্ত না হইয়া কি অবস্থা প্রাপ্ত হয়? হে মহাবাহো! সে কি যোগ ও কর্ম উভয় হইতে ভ্রষ্ট, নিরাশ্রয় ও ব্রহ্মলাভের উপায়ে অনভিজ্ঞ হইয়া ছিন্ন-মেঘের ন্যায় বিনাশ প্রাপ্ত হয় না? হে কৃষ্ণ! তুমি আমার এই সংশয় ছেদন কর; তোমা ভিন্ন আর কেহ এই সংশয় ছেদন করিতে সমর্থ হইবে না।’
“কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে পার্থ! যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি কি ইহলোকে, কি পরলোকে কুত্রাপি বিনষ্ট হয় না; কোন শুভকর্মকারীই দুর্গতি প্রাপ্ত হয় না, যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি পূণ্যকারীদিগের প্রাপ্য লোকে বহু বৎসর অবস্থান করিয়া সদাচার ও ধনসম্পন্নদিগের গৃহে অথবা বুদ্ধিমান যোগীদিগের বংশে জন্মগ্রহণ করে; যোগীদিগের কুলে জন্ম অতি দুর্লভ। যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি সেই জন্মে পৌর্বদেহিক (পূর্বজন্মলব্ধ) বুদ্ধি লাভ করে এবং মুক্তিলাভবিষয়ে পূর্বজন্ম অপেক্ষা অধিকতর যত্ন করিয়া থাকে। যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি কোন অন্তরায়(১)বশতঃ ইচ্ছা না করিলেও পূর্বজম্মকৃত অভ্যাসই তাকে ব্রহ্মনিষ্ঠ করে। তখন তিনি যোগজিজ্ঞাসু (২) হইয়াই বেদোক্ত কর্মফল অপেক্ষা সমধিক ফল লাভ করেন। নিষ্পাপ যোগী অধিকতর যত্নসহকারে অনেক জন্মে সিদ্ধ হইয়া পরিশেষে পরম গতি প্রাপ্ত হয়েন। হে অর্জুন! যোগী তপস্বী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং কর্মী অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ; অতএব তুমি যোগী হও। হে পার্থ! যে ব্যক্তি আমাতে অন্তকরণ সম্পর্পণ করিয়া শ্রদ্ধাপূর্ব্বক আমাকে ভজনা করেন, তিনি আমার মতে সকল যোগী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতম।’

সপ্তম অধ্যায় – জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ
“ভগবান্ কহিলেন, ‘হে অর্জুন! তুমি আমার প্রতি অনুরক্ত ও আমার আশ্রিত হইয়া যোগাভ্যাসপূর্বক যে প্রকারে আমাকে সম্পূর্ণরূপে অবগত হইতে পারিবে, তাহা শ্রবণ কর। আমি যে অনুভবসহকৃত (অনুভবের সহিত আচরিত) জ্ঞান সম্যক্রূপে কীর্তন করিতে প্রবৃত্ত হইতেছি, ইহা বিদিত হইলে, শ্রেয়োবিষয়ে (মুক্তিরূপ মঙ্গল সম্বন্ধ) আর কিছুই জ্ঞাত হইতে অবশিষ্ট থাকে না। সহস্র সহস্র মনুষ্যমধ্যে কোন ব্যক্তি আত্মজ্ঞানের নিমিত্ত যত্নবান হয়; আর যত্মশীল সিদ্ধ ব্যক্তিগণের মধ্যে কোন ব্যক্তি প্রকৃতরূপে আমাকে জ্ঞাত হইতে সমর্থ হয়। আমার মায়ারূপ প্রকৃতি ভূমি, জল, অনল, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার, এই আট প্রকারে বিভক্ত এতদ্ভিন্ন আমার একটি জীবস্বরূপ পরা (সর্বশ্রেষ্ঠ) প্রকৃতি আছে, উহা এই জগৎ ধারণ করিয়া রহিয়াছে। হে পার্থ! স্থাবরজঙ্গমাত্মক ভূত-সমুদয় এই ক্ষেত্র (প্রকৃতি) ও ক্ষেত্রজ্ঞ(জীবাত্মা)স্বরূপ প্রকৃতিদ্বয় হইতে সমুৎপন্ন হইতেছে। অতএব আমিই এই সমস্ত বিশ্বের পরম কারণ ও আমিই ইহার প্রলয়কর্ত্তা (লয়কারক); হে ধনঞ্জয়! আমা ভিন্ন ইহার সৃষ্টি-সংহারের (উৎপত্তির উপসংহারের–প্রবাহনিবৃতির) আর শ্রেষ্ঠ স্বতন্ত্র কারণ নাই। যেমন সূত্রে মণি সকল গ্রথিত থাকে, তদ্রুপ আমাতেই এই বিশ্ব গ্রথিত রহিয়াছে। হে অর্জুন! আমি সলিলে রসরূপে, চন্দ্র-সূর্য্যে প্রভাবরূপে, সমুদয় বেদে ওঁকাররূপে, আকাশে শব্দরূপে, মনুষ্য সকলে পৌরুষরূপে, পৃথিবীতে পবিত্র গন্ধরূপে, অনলে তেজোরূপে, সর্বভূতে জীবনরূপে ও তপস্বিগণে তপস্যারূপে অবস্থান করিতেছি। হে পার্থ! তুমি আমাকে সর্বভূতের সনাতন (নিত্য–ক্ষয়রহিত) বীজ বলিয়া বিদিত হও। আমি বুদ্ধিমানদিগের বুদ্ধি, তেজস্বীদিগের তেজ, বলবানের দুরাকাঙ্খাশূন্য বল ও সর্বভূতের বল ও ধর্মানুগত কাম। যে সমস্ত সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভাব আছে, তাহা আমা হইতে উৎপন্ন এবং আমারই অধীন; কিন্তু আমি কদাচ ঐ সকলের বশীভূত নহি। জগতীস্থ (ব্রহ্মাণ্ডস্থিত) সমুদয় লোক এই ত্রিগুণাত্মক (সত্ব, রজঃ ও তমঃ–এই ত্রিগুণগঠিত) ভাবে বিমোহিত হইয়া আমাকে ইহাদের অতিরিক্ত অবিনাশী বলিয়া বিদিত হইতে সমর্থ হয় না।
“অলৌকিক গুণময়ী নিতান্ত দুস্তরা আমার এক মায়া আছে; যাহারা আমাকে আশ্রয় করে, তাহারাই ঐ মায়া অতিক্রম করিতে সমর্থ হয়। ঐ মায়া কর্তৃক যাহাদিগের জ্ঞান অপহৃত হইয়াছে এবং যাহারা অসুরভাব অবলম্বন করিয়াছে, সেই সমস্ত দুষ্কর্মকারী নরাধম মূর্খ কদাচ আমাকে প্রাপ্ত হয় না। আর্ত্ত (পীড়িত–কাতর), আত্মজ্ঞানাভিলাষী, অর্থাভিলাষী ও জ্ঞানী, হে অর্জুন! এই চাই প্রকার পুণ্যবান লোক আমার আরাধনা করিয়া থাকে; তন্মধ্যে অতিমাত্র ভক্ত ও যোগযুক্ত জ্ঞানীই শ্রেষ্ঠ। আমি জ্ঞানবানের এবং জ্ঞানবান্ আমার একান্ত প্রিয়। পূর্বোক্ত চারি প্রকার উপাসকই মোক্ষ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন; কিন্তু আমার মতে জ্ঞানীই আত্মস্বরূপ; তিনি মদেকচিত্ত (একমাত্র ভগবানেই অর্পিতচিত্ত) হইয়া আমাকে একমাত্র উত্তম গতি অবধারণ করিয়া আশ্রয় করিয়া থাকেন। বহুজন্ম অতিক্রান্ত হইলে জ্ঞানবান্ ব্যক্তি বাসুদেবই এই সচরাচর বিশ্ব, এইরূপ বিবেচনা করিয়া আমাকে প্রাপ্ত হয়েন; কিন্তু তাদৃশ মহাত্মা নিতান্ত দুর্লভ। অন্য উপাসকেরা স্বীয় প্রকৃতির বশীভূত ও নানা প্রকার কামনা দ্বারা হতজ্ঞান হইয়া প্রসিদ্ধ (গতানুগতিক–রুচিকর) নিয়ম অবলম্বনপূর্বক ভূত, প্রেত প্রভৃতি ক্ষুদ্র দেবতাদিগের আরাধনা করিয়া থাকে। যে যে ভক্ত শ্রদ্ধাসহকারে যে কোন দেবতার অর্চনা করিতে অভিলাষ করেন, আমিই তাঁহাদিগকে সেই অচলা শ্রদ্ধা প্রদান করিয়া থাকি, তাঁহারা সেই শ্রদ্ধাসহকারে সেই সকল দেবতার আরাধনা করিতে প্রবৃত্ত হন; তৎপরে আমা হইতেই হিতকর অভিলষিতসকল প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। কিন্তু সেই সমস্ত অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদিগের দেবতালব্ধ (দেবতা হইতে প্রাপ্ত) ফল-সমুদয় ক্ষয় হইয়া যায়। দেবযাজী ব্যক্তিরা দেবতা প্রাপ্ত হয়, আর আমার ভক্তগণ আমাকেই প্রাপ্ত হইয়া থাকে। আমি অব্যক্ত; কিন্তু নির্বোধ মনুষ্যেরা আমার অব্যয় ও অতি উৎকৃষ্ট স্বরূপ অবগত না হইয়া আমাকে মনুষ্য, মীন ও কূর্মাদিভাবাপন্ন মনে করে। আমি যোগমায়ায় প্রচ্ছন্ন হইয়া আছি, সকলের সমক্ষে কদাচ প্রকাশমান হই না; এই নিমিত্ত মূঢ়েরা আমাকে জন্মহীন ও অব্যয় বলিয়া অবগত নহে। হে অর্জুন! আমি ভূত, ভবিষ্যত ও বর্তমান এই তিন বিষয়ই বিদিত আছি, কিন্তু আমাকে কেহই জ্ঞাত নহে। হে অর্জুন! জন্মগ্রহণ করিলে ভূতসকল ইচ্ছাদ্বেষসমুত্থিত শীতোষ্ণাদিদ্বন্দ্ব নিমিত্ত মোহে বিমোহিত হইয়া থাকে; কিন্তু যে সমস্ত পুণ্যাত্মাদিগের পাপ বিনষ্ট ও শীতোষ্ণাদি দ্বন্দ্ব-নিমিত্ত মোহ অপগত হইয়াছে, সেই সমস্ত কঠোর-ব্রতপরায়ণ মহাত্মারাই আমার আরাধনা করেন। যাঁহারা আমাকে আশ্রয় করিয়া জরা-মৃত্যু হইতে বিনির্মুক্ত হইবার জন্য যত্ন করেন, তাঁহারাই সমগ্র অধ্যাত্মবিষয়, নিখিল কর্ম ও সনাতন ব্রহ্ম অবগত হইতে সমর্থ হয়েন। যাহারা অধিভূত, অধিদৈব ও অধিযজ্ঞের সহিত আমাকে সম্যক্ বিদিত হইয়াছেন, সেই সমস্ত মহাহিতচিত্ত ব্যক্তি মৃত্যুকালেও আমাকে বিস্মৃত হয়েন না।’

অষ্টম অধ্যায় – অক্ষরব্রহ্মযোগ
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! ব্রহ্ম, অধ্যাত্ম ও কর্ম কাহাকে বলে? অধিভূত ও অধিদৈবই বা কি? মনুষ্যদেহে অধিযজ্ঞ কিরূপে অবস্থান করিতেছে? সংযতচিত্ত ব্যক্তিরা মৃত্যুকালে কি প্রকারে ব্রহ্মকে বিদিত হয়েন?’
“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে অর্জুন! যিনি পরম, অক্ষয় ও জগতের মূল কারণ, তিনিই ব্রহ্ম। সেই ব্রহ্মের অংশস্বরূপ জীব, দেহ অধিকার করিয়া অবস্থান করিলে তাহাকে অধ্যাত্ম বলা যায়। যাহাতে ভূতগণের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি সম্পন্ন হইয়া থাকে, তাহা যজ্ঞকর্ম। বিনশ্বর (বিনাশশীল) দেহাদি পদার্থ ভূত-সকলকে অধিকার করিয়া থাকে; এই নিমিত্ত উহাকে অধিভূত বলা যায়। সূর্যমণ্ডলবর্তী বৈরাজ পুরুষ দেবতাদিগের অধিপতি বলিয়া তাঁহকে অধিদৈবত বলা যায়। আর আমিই এই দেহে যজ্ঞের অধিষ্ঠাত্রী দেবতারূপে অবস্থান করিতেছি, এই নিমিত্ত অধিযজ্ঞ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকি। যিনি অন্তকালে আমাকে স্মরণ করিয়া কলেরব পরিত্যাগপূর্বক প্রয়াণ করেন, তিনি নিঃসন্দেহ আমার স্বরূপ প্রাপ্ত হয়েন। হে অর্জুন! যে ব্যক্তি একান্তমনে অন্তকালে যে যে বস্তু স্মরণ করিয়া দেহত্যাগ করে, সে সেই বস্তুর স্বরূপ প্রাপ্ত হইয়া থাকে; অতএব তুমি সকল সময়ে আমাকে স্মরণ কর ও সমরে প্রবৃত্ত হও। আমাতে মন ও বুদ্ধি সমর্পণ করিলে আমাকেই প্রাপ্ত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। হে অর্জুন! অভ্যাসরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া অনন্যমনে সেই দিব্য পরমপুরুষকে চিন্তা করিলে তাঁহাতেই লীন হয়। যে ব্যক্তি মৃত্যুকালে অবিচলিত-চিত্তে ভক্তি ও যোগবলে ভ্রুযুগলের মধ্যে প্রাণবায়ু সমাবেশিত করিয়া পুরাতন, বিশ্বনিয়ন্তা (ব্রহ্মাণ্ডপরিচালক), সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্ম, সকলের বিধাতা, অচিন্তরূপ, আদিত্যের ন্যায় স্বপ্রকাশ, অজ্ঞানান্ধকারের উপর (অজ্ঞানরূপ অন্ধকারের অতীত অবস্থা) বর্তমান, দিব্য পরমপুরুষকে চিন্তা করে, সে তাঁহাকে প্রাপ্ত হয়। হে অর্জুন! বেদবেত্তারা যাঁহাকে অক্ষয় বলিয়া থাকেন এবং বিষয়াসক্তিশূন্য যতিগণ যাঁহাতে প্রবেশ করেন ও যাঁহাকে বিদিত হইবার নিমিত্ত ব্রহ্মচর্যানুষ্ঠানের প্রবৃত্ত হয়েন, আমি সেই প্রাপ্য বস্তুলাভের উপায় সংক্ষেপে কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর :–
“যে ব্যক্তি ইন্দ্রিয়দ্বার-সমুদয় সংযত, হৃদয়কমলে মনকে নিরুদ্ধ ও ভ্রুমধ্যে প্রাণবায়ু সন্নিবেশিত করিয়া যোগজনিত ধৈর্য অবলম্বন এবং ব্রহ্মের অভিধান (১) ওঁ এই একাক্ষর উচ্চারণ ও আমাকে স্মরণ করিয়া কলেরব পরিত্যাগপূর্বক প্রয়াণ করেন, তিনি পরম গতি লাভ করিয়া থাকেন। যিনি অনন্যমনে সতত আমাকে স্মরণ করেন, সেই সমাহিত যোগী আমাকে অনায়াসে লাভ করিতে সমর্থ হয়েন; মহাত্ম্রারা আমাকে প্রাপ্ত হইয়াও মোক্ষরূপ পরম সিদ্ধি লাভ করিয়া দুঃখের আলয় অনিত্য পুনর্জন্ম প্রাপ্ত হয়েন না। প্রাণিগণ ব্রহ্মলোক অবধি সমুদয় লোক হইতেই পুনরায় প্রতিনিবৃত্ত হয়; কিন্তু আমাকে প্রাপ্ত হইলে আর জন্মগ্রহণ করিয়ে হয় না। সহস্র দৈব যুগে ব্রহ্মার এক দিন এবং ঐরূপ সহস্র যুগে এক রাত্রি হয়। যাঁহারা ইহা বিদিত হইয়াছেন, সেই সর্ব্বজ্ঞ ব্যক্তিরাই অহোরাত্রবেত্তা (দিবারাত্রির পরিমাণ বিষয়ে বিজ্ঞ)। ব্রহ্মার দিবস হইতে ব্যক্ত চরাচর ভূত-সকল প্রাদুর্ভূত হইয়া থাকে; আর রাত্রি উপস্থিত হইলে সেই কারণরূপ অব্যক্ত পদার্থে সমস্ত বস্তু বিলীন হইয়া যায়। সেই ভূতসমূহ ব্রহ্মার দিবসাগমে বার বার জন্মগ্রহণ করিয়া রাত্রিসমাগমে বিলীন হয় এবং পুনরায় দিবসাগমে কর্মাদিপরতন্ত্র ও সমুৎপন্ন হইয়া পুনরায় রাত্রিসমাগমে বিলীন হইয়া থাকে। সেই চরাচরের কারণরূপ অব্যক্তি অপেক্ষাও পরতর (নিগূঢ়) অতিশয় অব্যক্তি সনাতন আর একটি ভাব আছে; উহা সমস্ত ভূত বিনষ্ট হইলেও কদাচ বিনষ্ট হয় না। অতীন্দ্রিয় ও অক্ষয় ভাবকেই পরমপুরুষার্থ বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়া থাকেন; উহাই আমার স্বরূপ; উহা প্রাপ্ত হইলে মনুষ্যের আর বিনিবর্তন হয় না (ফিরিয়া আসে না–ব্রহ্মেই লীন হইয়া থাকে)। হে অর্জুন! সেই পরম-পুরুষকে একান্ত ভক্তি দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায়; ভূতসকল তাঁহার অভ্যন্তরে অবস্থান করিতেছে এবং তিনিই এই বিশ্বে ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছেন। যোগীরা যে কালে গমন করিলে আবৃত্তি (জন্মবন্ধন) ও যে কালে গমন করিলে অনাবৃত্তি (সংসারনিবৃত্তি–মোক্ষ) প্রাপ্ত হইয়া থাকেন, আমি সেই কালের বিষয় কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর;–যে স্থানে দিবস শুক্লবর্ণ (সত্ত্বময়) ও অগ্নির ন্যায় প্রভাসম্পন্ন এবং ছয় মাছ উত্তরায়ণ (মাঘ মাস হইতে আষাঢ় মাস পর্যন্ত), ব্রহ্মবেত্তারা তথায় গমন করিয়া ব্রহ্ম প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। আর যে স্থানে রাত্রি, ধূম ও কৃষ্ণবর্ণ (রজঃ ও তমোময়) এবং ছয় মাস দক্ষিণায়ণ (শ্রাবণ হইতে পৌষ মাস পর্যন্ত); কর্মযোগীরা তথায় চন্দ্রপ্রভাশালী স্বর্গ-লাভ (পিতৃলোক) কইয়া নিবৃত্ত হয়েন। জগতের শুক্ল ও কৃষ্ণবর্ণ দুইটা শাশ্বত গতি আছে; তন্মধ্যে একতর দ্বারা অনাবৃত্তি ও অন্যতর দ্বারা আবৃত্তি হইয়া থাকে। হে পার্থ! যোগী ব্যক্তি এই দুইটি গতি অবগত হইয়া কদাচ বিমোহিত হয়েন না; অতএব তুমি সকল কালে যোগানুষ্ঠানপরায়ণ হও। শাস্ত্রে বেদ, যজ্ঞ, তপস্যা ও দানে যে ফল নির্দিষ্ট আছে, জ্ঞানীরা সেই নির্ণীত তত্ত্ব অবগত হইয়া তদপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ফল লাভ করেন এবং জগতের মূল বিষ্ণুপদ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।’ ”

নবম অধ্যায় – রাজবিদ্যা-রাজগুহ্যযোগ
“ভগবান্‌ কহিলেন, ‘হে অর্জুন! তুমি অসূয়াশূন্য; অতএব যাহা অবগত হইলে সংসারবন্ধন হইতে মুক্ত হইবে, আমি সেই গোপনীয় উপাসনাসহকৃত ঈশ্বরজ্ঞান কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। এই উৎকৃষ্ট জ্ঞান বিদ্যাশ্রেষ্ঠ, রাজগণেরও গোপনীয়, অতি পবিত্র, প্রত্যক্ষফলদ, ধর্মানুগত ও অব্যয়; ইহা অনায়াসেই অনুষ্ঠান করা যাইতে পারে। যাহারা এই ধর্মে বিশ্বাস না করে, তাহারা আমাকে প্রাপ্ত না হইয়া মৃত্যুসমাকুল সংসারপথে নিয়ত পরিভ্রমণ করিয়া থাকে। হে অর্জুন! আমি অব্যক্তরূপে সমস্ত বিশ্বে ব্যাপ্ত রহিয়াছি; আমাতে ভূত-সকল অবস্থান করিতেছে; কিন্তু আমি কিছুতেই অবস্থিত নহি, আর আমাতেও কোন ভূত অবস্থান করিতেছে না; আমার এই ঐশিকী (ঐশী–নিয়তি বিষয়িণী) অঘটনঘটনাচাতুরী (অসম্ভব-সম্ভবকারিণী নিপুণতা) নিরীক্ষণ কর। আমার আত্মা ভূতসকল ধারণ ও পালন করিতেছে; কিন্তু কোন ভূতেই অবস্থান করিতেছে না। যেমন সমীরণ সর্বত্রগামী ও মহৎ হইলেও প্রতিনিয়ত আকাশে অবস্থান করে, তদ্রুপ সকল ভূতই আমাতে অবস্থান করিয়া রহিয়াছে জানিবে। হে অর্জুন! কল্পক্ষয়কালে (ব্রহ্মার স্থিতিকালের অবসানে–মহাপ্রলয় সময়ে) ভূতগণ আমার ত্রিগুণাত্মিকা মায়ায় লীন হয় এবং কল্পপ্রারম্ভে আমি পুনরায় উহাদিগকে সৃষ্টি করিয়া থাকি। আমি স্বীয় মায়ায় অধিষ্ঠিত হইয়া জন্মান্তরীণ (পূর্ব পূর্ব জন্মের) কর্মানুসারে প্রলয়কালবিলীন (প্রলয়কালে লয়প্রাপ্ত) কর্মাদিপরবশ (স্ব স্ব ধর্মের অধীন) ভূত-সমুদয় বারংবার সৃষ্টি করিতেছি; কিন্তু আমি সেই সকল সৃষ্টি প্রভৃতি কর্মের আয়ত্ত (অধীন) নহি; আমি সকল কর্মেই অনাসক্ত হইয়া উদাসীনের ন্যায় নিরন্তর অবস্থান করিয়া থাকি। মায়া আমার অধিষ্ঠান (আশ্রয়) মাত্র লাভ করিয়া এই সচরাচর বিশ্ব সৃষ্টি করিতেছে এবং আমার অধিষ্ঠান নিমিত্তই এই জগৎ পুনঃ পুনঃ উৎপন্ন হইতেছে। আমি সকল ভূতের ঈশ্বর; আমি মানুষ-বিগ্রহ পরিগ্রহ করিয়াছি বলিয়া বিফল আশাসম্পন্ন, বিফল কর্মপরায়ণ, বিফল জ্ঞানযুক্ত বিচেতন, মূঢ় ব্যক্তিরা আমার পরম তত্ত্ব অবগত না হইয়া আমাকে অবজ্ঞা করিয়া থাকে; কারণ, তাহারা রাক্ষসী , আসুরী ও মোহিনী (মোহকারিণী রাক্ষস ও অসুরসম্বন্ধীয়া) প্রকৃতি আশ্রয় করিয়া আছে। কিন্তু মহাত্মগণ দৈবী প্রকৃতি আশ্রয়পূর্বক আমাকে সকল ভূতের কারণ ও অব্যয়রূপ অবগত হইয়া অনন্যমনে আরাধনা করেন; সতত ভক্তিযুক্ত ও বহিত হইয়া আমার নাম কীর্তন করেন, যত্নবান ও দৃঢ়ব্রত হইয়া আমাকে নমস্কার করিয়া থাকেন এবং প্রতিনিয়ত সাবধান হইয়া ভক্তিসহকারে আমার উপাসনা করেন। আর কেহ তত্ত্বজ্ঞানরূপ যজ্ঞ, হেক অভেদ ভাবনা, কেহ পৃথক ভাবনা দ্বারা, কেহ বা সর্বাত্মক বলিয়া ব্রহ্মরুদ্রাদিরূপে আমাকে আরাধনা করিয়া থাকেন। দেখ, আমি যজ্ঞ, স্বধা, ঔষধ, মন্ত্র, আজ্য, অগ্নি ও হোম; আমি এই জগতের পিতা, পিতামহ, মাতা ও বিধাতাল আমি জ্ঞেয়, পবিত্র, ওঁঙ্কার, ঋক্‌, সাম ও যজু; আমি কর্মফল, ভর্তা (পালনকর্তা), প্রভু, সাক্ষী, নিবাস, শরণ, সুহৃৎ, প্রভব, প্রলয়, আধার, লয়স্থান ও অব্যয় বীজ। হে অর্জুন! আমি তাপপ্রদান এবং বৃষ্টিরোধ ও বৃষ্টি প্রদান করি। আমিই অমৃত, মৃত, সৎ ও অসৎ।
“ত্রিবেদবিহিত কর্মানুষ্ঠানপর (কর্মানুষ্ঠাননিরত), সোমপায়ী বিগত পাপ মহাত্মগণ যজ্ঞ দ্বারা আমার সৎকার করিয়া সুরলোকলাভের অভিলাষ করেন, পরিশেষে অতি পবিত্র সুরলোক প্রাপ্ত হইয়া উৎকীইষ্ট দেবভোগ্যসকল উপভোগ করিয়া থাকেন। অনন্তর পুণ্যক্ষয় হইলে পুনরায় মর্ত্যলোকে প্রবেশ করেন। এইরূপে তাঁহারা বেদত্রয়বিহিত কর্মানুষ্ঠানপর ও ভোগবিলাষী হইয়া গমনাগমন (জন্ম-মৃত্যুরূপ সংসারে আগমন–সংসার হইতে গমন) করিয়া থাকেন। যাহারা অনন্যমনে আমাকে চিন্তা ও আরাধনা করে, আমি সেই সকল মদেকনিষ্ঠ ব্যক্তিদিগকে যোগক্ষেমপ্রদান করিয়া থাকি। যাহারা শ্রদ্ধা-ভক্তিসহকারে অন্য দেবতার আরাধনা করে, তাহারা অবিধিপূর্বক আমাকেই পূজা করিয়া থাকে। আমি সকল যজ্ঞের ভোক্তা ও প্রভু; কিন্তু তাহারা আমাকে যথার্থতঃ বিদিত হইতে পারে না; এই নিমিত্ত স্বর্গভ্রষ্ট হইয়া থাকে। দেবব্রতপরায়ণ (যজ্ঞাদিনিষ্ঠ) ব্যক্তিরা দেবগণ, পিতৃব্রতনিষ্ঠ ব্যক্তিরা পিতৃগণ ও ভূতসেবকেরা ভূত-সকলকে এবং আমার উপাসকেরা আমাকেই প্রাপ্ত হয়। যিনি ভক্তিসহকারে আমাকে ফল, পত্র, পুষ্প ও জল প্রদান করেন, আমি সেই মহাত্মা ব্যক্তির সমুদয় দ্রব্য ভক্ষণ ও পান করিয়া থাকি। হে অর্জুন! তুমি যে কিছু কর্ম অনুষ্ঠান, যাহা ভক্ষণ, যাহা হোম, বে বস্তু দান ও যেরূপ তপঃসাধন করিয়া থাক, তৎসমুদয় আমাকে সমর্পণ করিও; তাহা হইলে কর্মজনিত শুভাশুভ ফল হইতে বিমুক্ত হইবে এবং কর্মার্পণরূপ (কর্মফলত্যাগরূপ) যোগযুক্ত হইয়া আমাকে লাভ করিবে। আমি সকল ভূতে একরূপ; কেহ আমার শত্রু বা মিত্র নাই। যাহারা ভক্তিপূর্বক আমার আরাধনা করে, তাহারা আমাতেই অবস্থান করিয়া থাকে। যদি দুরাচার ব্যক্তিও অনন্যমনে আমার উপাসনা করে, সে সাধু; তাহার অধ্যবসায় অতি সুন্দর; সে অবিলম্বে ধর্মপরায়ণ হইয়া নিরন্তর শান্তি লাভ করে এবং তাহার বিনাশ নাই। অতি পবিত্র ব্রাহ্মণ ও ভক্তিপরায়ণ রাজর্ষিগণের কথা দূরে থাকুক, যাহারা নিতান্ত পাপাত্মা, যাহারা কৃষি প্রভৃতি কার্যে নিরত বৈশ্য ও যাহারা অধ্যয়নবিরহিত শূদ্র, তাহারা এবং স্ত্রীলোকেরাও আমাকে আশ্রয় করিলে অত্যুৎকৃষ্ট গতি লাভ করিতে পারে। হে অর্জুন! তুমি এই অনিত্য অসুখকর লোক প্রাপ্ত হইয়া আমাকে আরাধনা ও নমস্কার কর; আমাকে মন সমর্পণপূর্বক আমার প্রতি ভক্তিপরায়ণ হও এবং সর্বদা আমার পূজা কর। তুমি এইরূপে আমাতে আত্মা সমাহিত করিলে আমাকে লাভ করিবে।’ “
দশম অধ্যায় – বিভূতিযোগ
“ভগবান্‌ কহিলেন, ‘হে অর্জুন! তুমি আমার বাক্যশ্রবণে নিতান্ত প্রীত হইতেছে; এক্ষণে আমি তোমার হিতবাসনায় পুনরায় যে সমস্ত উৎকৃষ্ট বাক্য কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। মহর্ষি ও সুরগণও আমার প্রভাব অবগত নহেন; আমি সকল বিষয়েই তাঁহাদিগের আদি। যিনি আমাকে অনাদি, জন্মবিহীন ও সকল লোকের ঈশ্বর বলিয়া জানেন, তিনি জীবলোকে মোহবিরত ও পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া থাকেন। আমি বুদ্ধি, জ্ঞান, ব্যাকুলতা, ক্ষমা, সত্য, দম, শম, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয়, অভয়, অহিংসা, সমতা, তুষ্টি, তপঃ, দান, যশঃ ও অযশ। আমা হইতেই প্রাণীগণের ভিন্ন ভিন্ন ভাব উৎপন্ন হইতেছে। পূর্বতন সনকাদি চারিজন ও ভৃগু প্রভৃতি সাতজন মহর্ষি এবং মনুসকল (স্বায়ম্ভুবপ্রমুখ) আমারই প্রভাবসম্পন্ন ও আমারই মন হইতে সমুৎপন্ন হইয়াছেন। তাঁহারা এই লোক ও প্রজা সৃষ্টি করিয়াছেন। যিনি আমার এই বিভূতি ও সর্বজ্ঞতাদি ঐশ্বর্য্য (সমস্ত জানিবার শক্তি) সম্যক্‌ বিদিত হইয়াছেন, তিনি সংশয়রহিত জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েন, সন্দেহ নাই। পণ্ডিতেরা আমাকে সকলের কারণ ও আমা হইতে সমস্ত প্রবর্তিত জানিয়া প্রীতমনে আমার অর্চনা করেন। তাঁহারা আমাতে মনঃ ও প্রাণ সমর্পণ করিয়া আমাকে বিদিত হয়েন এবং আমার নাম কীর্তন করিয়া একান্ত সন্তোষ ও পরম শান্তিলাভ করিয়া থাকেন। আমি অনুকম্পা প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত তাঁহাদিগের বুদ্ধিবৃত্তিতে অবস্থিত হইয়া দীপ্তিশীল জ্ঞানপ্রদীপদ্বারা অজ্ঞানান্ধকার নিরাকরণ (দূর) করিয়া থাক।’
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! ঋষিগণ, দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবল ও ব্যাসদেব তোমাকে পরম ব্রহ্ম, পরম ধাম, পরম পবিত্র, শাশ্বত, পুরুষ, দিব্য, আদিদেব ও জন্মবিহীন বলিয়া থাকেন এবং তুমিও আপনাকে ঐরূপ নির্দেশ করিলে। এক্ষণে তুমি যেরূপ কহিতেছ, আমি তদ্বিষয় অনুমাত্রও (অতি অল্প পরিমাণও) সন্দেহ করি না। দেব ও দানবগণ তোমাকে সম্যক্‌ অবগত নহেন; তুমি আপনিই আপনাকে বিদিত হইতেছ। হে দেবদেব! হে ভূতভাবন (প্রাণীগণের উৎপাদন কারক)! তুমি যে সমস্ত বিভূতিদ্বারা এই লোকসমুদয় ব্যাপ্ত করিয়া রহিয়াছ, এক্ষণে সেইসকল দিব্যবিভূতি সম্যক্‌রূপে কীর্তন কর, আমি কিরূপে তোমাকে সতত চিন্তা করিয়া অবগত হইতে সমর্থ হইব এবং কোন্‌ কোন্‌ পদার্থেই বা তোমাকে চিন্তা করিব? এক্ষণে তুমি পুনরায় সবিস্তার আপনার ঐশ্বর্য্য ও বিভূতি কীর্তন কর; তোমার এই অমৃতোপম বাক্য শ্রবণ করিয়া কিছুতেই আমার তৃপ্তিলাভ হইতেছে না।’
“বাসুদেব বলিলেন, ‘হে অর্জুন! আমার বিভূতির ইয়ত্তা নাই; অতএব প্রধান প্রধান বিভূতিসকল কীর্তন করিতেছে, শ্রবণ কর। হে অর্জুন! আত্মা ও সকল প্রাণীর অন্তঃকরণে অবস্থান করিতেছি। আমি সকলের আদি, মধ্য, ও অন্ত; আমি আদিত্যগণের মধ্যে বিষ্ণু, জ্যোতির্মণ্ডলীর মধ্যে সমুজ্জ্বল সূর্য্য, মরুদ্‌গণের মধ্যে মরীচি ও নক্ষত্রগণের মধ্যে চন্দ্র। আমি বেদের মধ্যে সাম, দেবগণের মধ্যে ইন্দ্র। ইন্দ্রিয়সমুদয়ের মধ্যে মন ও ভূতগণের মধ্যে চৈতন্য। আমি রুদ্রগণের মধ্যে শঙ্কর, যক্ষরাক্ষসের মধ্যে কুবের, বসুগণের মধ্যে পাবক, পর্বতের মধ্যে সুমেরু, পুরোহিতগণের মধ্যে সর্বপ্রধান বৃহস্পতি, সেনানীদিগের মধ্যে কার্তিকেয় জলাশয়সকলের মধ্যে সাগর। আমি মহর্ষিগণের মধ্যে ভৃগু, বাক্যসকলের মধ্যে ওঁকার, যজ্ঞসমুদয়ের মধ্যে জপযজ্ঞ, স্থাবরগণের মধ্যে হিমালয়, বৃক্ষসমূহের মধ্যে অশ্বত্থ, দেবর্ষিগণের মধ্যে নারদ, গন্ধর্বগণের মধ্যে চিত্ররথ ও সিদ্ধসমুদয়ের মধ্যে মহামুনি কপিল। আমি অশ্বগণমধ্যে অমৃতমন্থনোদ্ভূত (অমৃতমন্থনকালে সমুদ্র হইতে উত্থিত) উচ্চৈঃশ্রবা, মাতঙ্গমধ্যে ঐরাবত, মনুষ্যমধ্যে রাজা, আয়ুধমধ্যে বজ্র ও ধেনুগণমধ্যে কামধেনু। আমি উৎপত্তিহেতু কন্দর্প (কাম), সবিষ ভুজঙ্গগণের মধ্যে বাসুকি, নির্বিষ ভুজঙ্গগণের মধ্যে অনন্ত, জলচরসকলের মধ্যে বরুণ, পিতৃগণের মধ্যে অর্য্যমা, নিয়ামকদিগের (শাসনদ্বারা সপথে প্রবর্তক) মধ্যে যম ও দৈত্যগণের মধ্যে প্রহ্লাদ। আমি গণনাকারীদিগের মধ্যে কাল, মৃগগণের মধ্যে মৃগেন্দ্র (সিংহ) পক্ষিমধ্যে বৈনতেয়, বেগবানদিগের মধ্যে পবন, শস্ত্রধারীদিগের মধ্যে দাশরথি রাম, মৎস্যগণমধ্যে মকর ও স্রোতস্বতীর (নদীর) মধ্যে জাহ্নবী। আমি সৃষ্টপদার্থ সকলের আদি, অন্ত ও মধ্য, বিদ্যাসকলের মধ্যে আত্মবিদ্যা, বাদিগণের বাদ, অক্ষরসকলের মধ্যে আকার, সমাসমধ্যে দ্বন্দ্ব। আমি অনন্ত কাল, সর্বতোমুখ (সকল দিকেই মুখবিশিষ্ট—সর্বত্র অস্তিত্বসম্পন্ন) বিধাতা, সর্বসংহারক মৃত্যু ও অদ্ভুদয়লাভের যোগ্য প্রাণীদিগের অদ্ভুদয় (মঙ্গল)। আমি নারীগণমধ্যে কীর্তি, শ্রী, বাক্‌ (বাক্য), স্মৃতি, মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা। আমি সামবেদের মধ্যে বৃহৎ সাম, ছন্দের মধ্যে গায়ত্রী, মাসের মধ্যে মার্গশীর্ষ (অগ্রহায়ণ), ঋতুর মধ্যে বসন্ত, প্রভারকদিগের দ্যূত ও তেজস্বীদিগের তেজঃ। আমি জয়, ব্যবসায় ও সত্ত্ববানদিগের সত্ত্ব। আমি বৃষ্ণিবংশীয়দিগের মধ্যে বাসুদেব, পাণ্ডবমধ্যে ধনঞ্জয়, মুনিদিগের ব্যাস ও কবিগণের মধ্যে শুক্র। আমি শাসনকর্তাদিগের দণ্ড, জয়াভিলাষীদিগের নীতি, গোপ্য বিষয়ের মধ্যে মৌনভাব, জ্ঞানবান্‌দিগের জ্ঞান ও সকল ভূতের বীজ। হে অর্জুন! এই চরাচর ভূত আমা হইতে স্বতন্ত্র নহে; সুতরাং আমি দিব্যবিভূতির ইয়ত্তা নাই। হে পার্থ! আমি সংক্ষেপে এই বিভূতিবিস্তার (ঐশ্বর্য্যের বিস্তৃত বৃত্তান্ত) কীর্তন করিলাম; বস্তুতঃ যে যে বস্তু ঐশ্বর্য্যযুক্ত ও প্রভাববলসম্পন্ন, সেই সমস্তই আমার প্রভাবের অংশদ্বারা সম্ভূত হইয়াছে। হে অর্জুন! আমি একাংশদ্বারা বিশ্বসংসারে ব্যাপ্ত হইয়া অবস্থান করিতেছি; অতএব এক্ষণে আমার বিভূতির বিষয় পৃথকরূপে জানিবার প্রয়োজন নাই।’ “

একাদশ অধ্যায় – বিশ্বরূপদর্শন
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করিয়া যে পরম গুহ্য আত্মা ও দেহ প্রভৃতির বিষয় কীর্তন করিলে, তদ্দ্বারা আমার ভ্রান্তি দূর হইয়াছে। হে পদ্মপলাশলোচন! আমি তোমার মুখে ভূতগণের উৎপত্তি, প্রলয় এবং তোমার অক্ষয়মাহাত্ম্য সবিস্তর শ্রবণ করিলাম। হে পুরুষোত্তম! তুমি আপনার ঐশ্বররূপের (ঈশ্বরাত্মকরূপ–ঐশ্বর্য্যযুক্তরূপ) বিষয় যেরূপ কীর্তন করিলে, তাহা আমি দর্শন লাভ করিতে অভিলাষ করি; হে যোগেশ্বর! এক্ষণে তুমি যদি আমাকে তাহা দর্শন করিবার উপযুক্ত বিবেচনা করিয়া থাক, তাহা হইলে সেই অব্যয় রূপ প্রদর্শন কর।’
“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে অর্জুন! তুমি আমার নানাবর্ণ ও নানাপ্রকার আকারবিশিষ্ট শত শত সহস্র সহস্র রূপ প্রত্যক্ষ কর। অদ্য আমার কলেরবে আদিত্য, বসু, রুদ্র ও মরুদ্‌গণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, অদৃষ্টপূর্ব অত্যাশ্চর্য্য বহুতর বস্তু-সকল দর্শন কর। হে অর্জুন! সচরাচর বিশ্ব এবং অন্য যে কিছু অবলোকন করিবার অভিলাষ থাকে, তাহাও নিরীক্ষণ কর। কিন্তু তুমি এই চক্ষু দ্বারা আমার রূপ প্রত্যক্ষ করিতে সমর্থ হইবে না; এক্ষণে আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু প্রদান করিতেছি; তুমি তদ্দ্বারা আমার অসাধারণ যোগ অবলোকন কর।’ ”
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহাযোগেশ্বর হরি পার্থকে বহুমুখ ও বহুনয়নসম্পন্ন, দিব্যালঙ্কারে অলঙ্কৃত, দিব্যায়ূধধারী, দিব্য মাল্য ও অম্বরে পরিশোভিত, দিব্যগন্ধচর্চ্চিত (উত্তম গন্ধে অনুলিপ্ত), সর্বতোমুখ, অদ্ভুতদর্শন, পরম ঐশ্বর রূপ প্রদর্শন করিলেন। যদি নভোমণ্ডলে এককালে সহস্র সূর্য সমুদিত হয়, তাহা হইলে তাহার তৎকালীন তেজঃপুঞ্জের উপমা হইতে পারে। ধনঞ্জয় তখন তাঁহার দেহে বহু প্রকারে বিভক্ত, একস্থানস্থিত, সমগ্র বিশ্ব নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় বিস্মিত ও পুলকিত হইলেন। পরে কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে নমস্কার করিয়া কহিলেন, ‘হে দেব! আমি তোমার দেহমধ্যে সমস্ত দেবতা, জরায়ুজ ও অণ্ডজ প্রভৃতি সমস্ত ভূত, পদ্মাসনস্থিত ভগবান্‌ ব্রহ্মা এবং দিব্য মহর্ষি ও উরগগণ অবলোকন করিতেছি। হে বিশ্বেশ্বর! আমি তোমার বহুতর বাহু, উদর, বক্ত্র ও নেত্রসম্পন্ন অনন্ত রূপ নিরীক্ষণ করিলাম; কিন্তু ইহার আদি, অন্ত ও মধ্যে কিছুই দেখিতে পাইলাম না। আমি তোমাকে কিরীটধারী, গদাচক্রলাঞ্ছিত (গদা ও চক্রচিহ্নে চিহ্নিত), প্রদীপ হুতাশন ও সূর্যসঙ্কাশ, নিতান্ত দুর্নিরীক্ষ্য এবং অপ্রমেয় নিরীক্ষণ করিতেছি। তুমি অক্ষয়, পরব্রহ্ম, জ্ঞাতব্য বিশ্বের একমাত্র আশ্রয়, নিত্য, সনাতন-ধর্মপ্রতিপালক পরমপুরুষ। তোমার আদি নাই, মধ্য নাই ও অন্ত নাই। তুমি অনন্তবীর্য ও অনন্তবাহু; হুতাশন তোমার মুখমণ্ডলে সতত প্রদীপ্ত হইতেছে; চন্দ্র ও সূর্য তোমার নেত্র; তুমি স্বীয় তেজঃপ্রভাবে এই বিশ্বকে সন্তপ্ত করিতেছ এবং একাকী হইয়াও অন্তরীক্ষ ও সমস্ত দিগ্বলয় ব্যাপ্ত করিয়া রহিয়াছ। তোমার এই ভীষণ অত্যদ্ভুত রূপ নিরীক্ষণ করিয়া এই লোকত্রয় ব্যথিত হইতেছে। সকল সুরগণ শঙ্কিতমনে তোমার শরণাপন্ন হইতেছেন। কেহ কেহ বা ‘আমাদিগকে রক্ষা কর’ বলিয়া কৃতঞ্জলিপুটে প্রার্থনা করিতেছেন; সিদ্ধ ও মহর্ষিগণ ‘স্বস্তি’ বলিয়া তোমার স্তুতিবাদে প্রবৃত্ত হইতেছেন। রুদ্র, আদিত্য, বসু, সাধ্য, মতুৎ পিতৃগণ, গন্ধর্ব, যক্ষ, অসুর, বিশ্বদেব ও সিদ্ধগণ এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয় সাতিশয় বিস্মিত হইয়া তোমাকে দর্শন করিতেছেন। আমি এই সমস্ত লোক-সমভিব্যাহারে তোমার বহু নয়ন ও অনেক মুখসম্পন্ন, বহু বাহু, বহু ঊরু ও বহু চরণসংযুক্ত, অনেক উদরপরিশোভিত ও বহুদংষ্ট্রাকরাল (ভীষণ দন্তসমন্বিত) আকার নিরীক্ষণ করিয়া নিতান্ত ব্যথিত হইতেছি; আমি তোমার নভোমণ্ডলস্পর্শী, বহু-বর্ণসম্পন্ন, বিবৃতানন, বিশাললোচন ও অতি প্রকাণ্ড মূর্তি সন্দর্শন করিয়া কোনক্রমেই ধৈর্য ও শান্তি অবলম্বন করিতে সমর্থ হইতেছি না। আমার অন্তঃকরণ নিতান্ত বিচলিত হইয়াছে। হে জগন্নাথ! তুমি প্রসন্ন হও, তমার কালাগ্নিসন্নিভ দংষ্ট্রাকরাল মুখমণ্ডল অবলোকন করিয়া আমার দিগ্‌ভ্রম জন্মিয়াছে; আমি কিছুতেই সুখলাভ করিতে সমর্থ হইতেছি না।
“মহাবীর ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ ও ধার্ত্তরাষ্ট্রেরা অন্যান্য মহীপালগণ ও আমাদিগের যোদ্ধৃবর্গ সমভিব্যাহারে সত্বর তোমার ভয়ঙ্কর আস্য বিবরে প্রবেশ করিতেছে; তন্মধ্যে কাহার উত্তমাঙ্গ চূর্ণীকৃত এবং কেহ বা তোমার বিশাল দশনসন্ধিতে (দাঁতের ফাঁকে) সংলগ্ন হইয়াছে। যেমন নদীপ্রবাহ সাগরাভিমুখে প্রবাহিত হইয়া থাকে, তদ্রুপ এই সকল বীরপুরুষেরা তোমার অতি প্রদীপ্ত মুখমধ্যে প্রবেশ করিতেছেন। যেমন সমৃদ্ধ বেগশালী পতঙ্গসকল বিনাশের নিমিত্ত অতি প্রদীপ্ত হুতাশনমধ্যে প্রবিষ্ট হয়, তদ্রুপ এই সমস্ত লোকেরা বিনিষ্ট হইবার নিমিত্ত তোমার মুখমধ্যে প্রবেশ করিতেছে। তুমি প্রজ্বলিত মুখ বিস্তার করিয়া এই সমুদয় লোককে গ্রাস করিতেছ এবং তোমার প্রখর তেজ বিশ্বকে পরিপূর্ণ করিয়া লোক-সকলকে সন্তপ্ত করিতেছে। হে দেবাদিদেব! আমি তোমাকে নমস্কার করি; তুমি প্রসন্ন হও। আমি তোমার কোন বৃতান্তই অবগত নহি; এক্ষণে তুমি কে, তাহা কীর্তন কর; আমি তোমাকে বিদিত হইতে অভিলাষী হইয়াছি।’
“বাসুদেব বলিলেন, ‘হে অর্জুন! আমি লোকক্ষয়কারী ভয়ঙ্কর সাক্ষাৎ কালরূপী হইয়া লোক-সকলকে বিনাশ করিতে প্রবৃত্তি হয়াছি। এক্ষণে কেবল তোমা ব্যতিরেকে প্রতিপক্ষীয় বীরপুরুষ সকলেই বিনষ্ট হইবেন; অতএব তুমি যুদ্ধার্থ উদ্যুক্ত হইয়া শত্রুগণকে পরাজিত করিয়া যশোলাভ ও অতি সমৃদ্ধ রাজ্য উপভোগ কর। হে অর্জুন! আমি পূর্বেই ইহাদিগকে নিহত করিয়া রাখিয়াছি; এক্ষণে তুমি এই বিনাশের নিমিত্তমাত্র হও। হে অর্জুন! আমি দ্রোণ, ভীষ্ম, জয়দ্রথ ও কর্ণ প্রভৃতি বীরগণকে বিনষ্ট করিয়া রাখিয়াছি; তুমি ইহাদিগকে সংহার কর; ব্যথিত হইও না; অনতিবিলম্বে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও; তুমি অবশ্যই শত্রুদিগকে পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে।’ ” সঞ্জয় কহিলেন, “তখন অর্জুন কম্পিতকলেরবে ও কৃতাঞ্জলিপুটে কৃষ্ণকে নমস্কার করিয়া ভীতমনে ও গদ্‌গদ্‌বচনে কহিলেন, “বাসুদেব! তোমার নাম কীর্তন করিলে সকলে যে নিতান্ত হৃষ্ট ও একান্ত অনুরক্ত হইয়া থাকে, সিদ্ধগণ যে তোমাকে নমস্কার করিয়া থাকেন এবং রাক্ষসেরা যে ভীত হইয়া চতুর্দিকে পলায়ণ করিয়া থাকে, তাহা যুক্তিযুক্ত। তুমি ভগবান্‌ ব্রহ্মা অপেক্ষা গুরুতর ও জগতের আদিকর্তা এবং ব্যক্ত ও অব্যক্তের মূলকারণ অবিনাশী ব্রহ্ম; এই নিমিত্তই সকলে তোমাকে নমস্কার করিয়া থাকে। তুমি আদিদেব, পুরাতন পুরুষ ও বিশ্বের একমাত্র বিধান (আধার); তুমি বেত্তা (সর্বজ্ঞ), বেদ্য (জ্ঞেয়) ও পরম তেজ; হে অনন্তমূর্তি! তুমি এই বিশ্বের সর্বত্রই বিরাজমান আছ। তুমি বায়ু, যম, অগ্নি, বরুণ, শশাঙ্ক (চন্দ্র), প্রজাপতি ও প্রপিতামহ (ব্রহ্মা)। হে সর্বেশ্বর! আমি তোমাকে সহস্র সহস্রবার নমস্কার করি; আমি তোমার সম্মুখে নমস্কার করি; আমি তোমার পশ্চাতে নমস্কার করি; আমি তোমার চতুর্দিকেই নমস্কার করি। তুমি অনন্তবীর্য ও অমিতপরাক্রমসম্পন্ন; তুমি সমুদয় বিশ্বে ব্যাপ্ত রহিয়াছ; এই নিমিত্ত সকলে তোমাকে সর্বস্বরূপ বলিয়া কীর্তন করিয়া থাকে। আমি তোমাকে মিত্র বিবেচনা করিয়া ‘হে কৃষ্ণ! এ যাদব! হে সখা!’ বলিয়া যে সম্বোধন করিয়াছি এবং তুমি একাকীই থাক বা বন্ধুজনসমক্ষেই অবস্থান কর, বিহার, শয়ন, উপবেশন ও ভোজন সময়ে তোমাকে যে উপহাস করিবার নিমিত্ত তিরস্কার করিয়াছি, এক্ষণে তুমি সেই সকল ক্ষমা কর; আমি তোমার মহিমা অবগত না হইয়া প্রমাদ বা প্রণয়পূর্বক ঐরূপ ব্যবহার করিতাম। তুমি স্থাবরজঙ্গমাত্মক জগতের পিতা, পূজ্য ও গুরু, ত্রিলোকমধ্যে তোমা অপেক্ষা সমধিক বা তোমার তুল্য প্রভাবসম্পন্ন আর কেহই নাই; অতএব আমি দণ্ডবৎ পতিত হইয়া তোমায় প্রণাম করিয়া প্রসণ্ন করিতেছি; যেমন পিতা পুত্রের, মিত্র মিত্রের ও স্বামী প্রিয়তমার অপরাধ সহ্য করিয়া থাকেন, সেইরূপ তুমিও আমার অপরাধ মার্জনা করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি তোমার অদৃষ্টপূর্ব (যাহা পূর্বে কখনও দেখা যায় নাই, তদ্রুপ) রূপ নিরীক্ষণ করিয়া নিতান্ত সন্তুষ্ট হইয়াছি; কিন্তু আমার অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার হইতেছে। হে কৃষ্ণ! তুমি প্রসন্ন হইয়া পূর্বরূপ ধারণ ও আমাকে প্রদর্শন কর, আমি তোমার কিরীটসমলঙ্কৃত গদা-চক্রলাঞ্ছিত সেই চতুর্ভূজ মূর্তি অবলোকন করিতে ইচ্ছা করি।’
“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে অর্জুন! আমি প্রসন্ন হইয়া যোগমায়া-প্রভাবে তোমাকে তেজোময় অনন্ত বিশ্বরূপ পরম রূপ প্রদর্শন করিয়াছি; তোমা ব্যতিরেকে আর কেহই ইহা পূর্বে নিরীক্ষণ করেন নাই। তোমা ব্যতিরেকে মনুষ্যলোকে আর কেহই বেদাধ্যয়ন, যজ্ঞানুষ্ঠান, দান, ক্রিয়াকলাপ ও অতি কঠোর তপস্যা দ্বারা আমার ঈদৃশ রূপ অবলোকন করিতে সমর্থ হয়েন না। তুমি ইহা নয়নগোচর করিয়া ব্যথিত ও বিমোহিত হইও না; এক্ষনে ভয় পরিত্যাগপূর্বক প্রীতমনে পুনরায় আমার পূর্বরূপ প্রত্যক্ষ কর।’ ” সঞ্জয় কহিলেন, “এই বলিয়া বাসুদেব নিতান্ত ভীত অর্জুনকে পুনরায় স্বকীয় সৌম্যমূর্তি প্রদর্শনপূর্বক আশ্বাস প্রদান করিলেন।
“তখন অর্জুন কৃষ্ণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে জনার্দন! আমি এক্ষণে তোমার প্রশান্ত মানুষ-মূর্তি নিরীক্ষণ করিয়া প্রকৃতিস্থ হইলাম।’
“কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে অর্জুন! তুমি আমার যে নিতান্ত দুর্নিরীক্ষ্য মূর্তি অবলোকন করিলে, দেবগণ উহা নেত্রগোচর করিবার নিমিত্ত নিয়ত অভিলাষ করিয়া থাকেন। কিন্তু কেহই বেদাধ্যয়ন, দান, তপঃ ও যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা আমার ঐ মূর্তি প্রত্যক্ষ করিতে সমর্থ হয় না; অনন্যসাধারণ ভক্তিপ্রদর্শন করিলেই আমাতে এইরূপে জ্ঞাত হইতে পারে এবং আমাকে দর্শন ও আমাতে প্রবেশ করিতে সমর্থ হয়। হে অর্জুন! যে ব্যক্তি আমার কর্মানুষ্ঠান করে, যে আমার ভক্ত ও একান্ত অনুরক্ত, যে পুত্র-কলত্র প্রভৃতি পরিবারের সহিত আসক্তিরহিত, যাহার কাহারও সহিত বিরোধ নাই এবং আমিই যাহার পরমপুরুষার্থ, সেই ব্যক্তিই আমাকে প্রাপ্ত হইয়া থাকে।’”

দ্বাদশ অধ্যায় – ভক্তিযোগ
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! যাহারা ত্বদ্‌গতচিত্তে (অনন্যমনে–একমাত্র ভগবানে মন রাখিয়া) তোমার উপাসনা করে এবং যাহারা কেবল অক্ষয় ও অব্যক্ত ব্রহ্মের আরাধনা করিয়া থাকে, এই উভয়বিধ লোকের মধ্যে কাহারা শ্রেষ্ঠ যোগী বলিয়া নির্দিষ্ট হয়?’
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! যাহারা ত্বদ্‌গতচিত্তে (অনন্যমনে–একমাত্র ভগবানে মন রাখিয়া) তোমার উপাসনা করে এবং যাহারা কেবল অক্ষয় ও অব্যক্ত ব্রহ্মের আরাধনা করিয়া থাকে, এই উভয়বিধ লোকের মধ্যে কাহারা শ্রেষ্ঠ যোগী বলিয়া নির্দিষ্ট হয়?’
“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! যাহারা আমার প্রতি নিতান্ত অনুরক্ত ও নিবিষ্টমনা হইয়া পরম ভক্তিসহকারে আমার উপাসনা করিয়া থাকে, তাহারাই আমার মতে প্রধান যোগী; আর যাহারা সর্বত্র সমদৃষ্টিসম্পন্ন, সর্বভূতে হিতানুষ্ঠাননিরত ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া অক্ষয়, অনির্দেশ্য (নির্দেশের অতীত–‘ইহা এই’ এই প্রকার পরিচয়ের বহির্ভূত), অব্যক্ত, অচিন্তনীয়, সর্বব্যাপী, হ্রাসবৃদ্ধিহীন, কূটস্থ (হৃদয়স্থ–হৃদয়ের অন্তঃস্তরস্থ) এবং নিত্য পরব্রহ্মের উপাসনা করে, তাহারা আমাকেই প্রাপ্ত হয়। দেহাভিমানীরা অতি কষ্টে অব্যক্ত গতি লাভ করিতে সমর্থ হয়; অতএব যাহারা অব্যক্ত ব্রহ্মে আসক্তমনা হয়, তাহারা অধিততর দুঃখভোগ করিয়া থাকে; যাহারা মৎপরায়ণ হইয়া আমাকে সমস্ত কার্য সমর্পণপূর্বক একান্ত ভক্তিসহকারে আমাকেই ধ্যান ও উপাসনা করে, আমি তাহাদিগকে অচিরকালমধ্যে এই মৃত্যুর আকর সংসার-সাগর হইতে উদ্ধার করিয়া থাকি।
“হে অর্জুন! তুমি আমাতে স্থিরতর রূপে চিত্ত আহিত (সংন্যস্ত) ও বুদ্ধি সন্নিবেশিত কর; তাহা হইলে পরকালে আমাতেই বাস করিতে সমর্থ হইবে। যদি আমার প্রতি চিত্ত স্থির রাখিতে না পার, তাহা হইলে আমার অনুস্মরণরূপ অভ্যাসযোগ দ্বারা আমাকে প্রাপ্ত হইতে অভিলাষ কর। যদি তদ্বিষয়েও অসমর্থ হও, তাহা হইলে তুমি আমার প্রীতিসম্পাদনার্থ ব্রত, পূজা প্রভৃতি কার্য-সকল অনুষ্ঠান করিলেও মোক্ষলাভ সমর্থ হইবে। যদি ইহাতেও অশক্ত হও, তাহা হইলে একমাত্র আমারই শরণাপন্ন হইয়া সংযতচিত্তে সকল কর্মফল পরিত্যাগ কর; কারণ, বিবেকশূন্য অভ্যাস অপেক্ষা জ্ঞান শ্রেয়স্কর; জ্ঞান অপেক্ষা ধ্যান শ্রেয়স্কর; ধ্যান অপেক্ষা কর্মফলপরিত্যাগ শ্রেয়স্কর, কর্মফল পরিত্যাগ করিলে শান্তিলাভ হয়। যে ভক্তিপরায়ণ ব্যক্তি দ্বেষশূন্য, কৃপালু, মমতাবিহীন, নিরহঙ্কার, সমদুঃখ-সুখ, ক্ষমাবান্‌, সতত প্রসন্নচিত্ত, অপ্রমত্ত, জিতেন্দ্রিয় ও দৃঢ়নিশ্চয়, যিনি আমাতেই মন ও বুদ্ধি সমর্পণ করিয়াছেন এবং সুখ ও দুঃখ সমান জ্ঞান করেন, তিনিই আমার প্রিয়; লোক-সকল যাঁহা হইতে উদ্বিগ্ন হয় না, যিনি লোকদিগকে উদ্বিগ্ন করেন না এবং যিনি অনুচিত হর্ষ, অমর্ষ, ভয় ও উদ্বেগশূন্য, তিনি আমার প্রিয়। যিনি নিস্পৃহ, শুচি, দক্ষ, পক্ষপাতরহিত ও আধিশূন্য এবং যিনি সকাম কর্মসকল পরিত্যাগ করিয়াছেন, তিনিই আমার প্রিয়। যিনি শোক, হর্ষ, দ্বেষ, আকাঙ্খা ও পূণ্য-পাপ পরিত্যাগ করিয়া ভক্তিমান্‌ হয়েন, তিনিই আমার প্রিয়। যিনি সর্বসঙ্গ পরিত্যাগপূর্বক শত্রু ও মিত্র, মান ও অপমান, শীত ও উষ্ণ, সুখ ও দুঃখ, নিন্দা ও প্রশংসা তুল্যরূপ বিবেচনা করিয়া থাকেন, যৎকিঞ্চিত লাভে সন্তুষ্ট হয়েন, কোন স্থলেই প্রতিনিয়ত বাস করেন না এবং স্থিরমতি ও স্থিরভক্তিসম্পন্ন হইয়াছেন, তিনিই আমার প্রিয়। যিনি মৎপরায়ণ হইয়া পরম শ্রদ্ধাসহকারে উক্ত প্রকার ধর্মরূপ অমৃত পান করেন, তিনিই আমার প্রিয়।’”


ত্রয়োদশ অধ্যায় – ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞযোগ
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! আমি প্রকৃতি, পুরুষ, ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞেয়, এই কয়েকটি বিষয় শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি।’
“কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে অর্জুন! এই শরীরই ক্ষেত্র বলিয়া অভিহিত হয়; যিনি ইহা বিদিত হইয়াছেন, তিনি ক্ষেত্রজ্ঞ; আমি সকল ক্ষেত্রেরই ক্ষেত্রজ্ঞ; ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের যে বৈলক্ষণ্য-জ্ঞান (বিশেষ ধারণা), তাহাই আমার অভিপ্রেত যথার্থ জ্ঞান। এক্ষণে ক্ষেত্র যে প্রকার ধর্মবিশিষ্ট, যে সমস্ত ইন্দ্রিয়বিকারযুক্ত, যেরূপে প্রকৃতি-পুরুষের সংযোগে উদ্ভূত হয়, যেরূপে স্থাবরজঙ্গমাদিভেদ বিভিন্ন হয়, স্বরূপতঃ যেরূপ এবং যে প্রকার প্রভাবসম্পন্ন, তাহা সংক্ষেপে কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। বশিষ্ঠ প্রভৃতি ঋষিগণ হেতুবিশিষ্ট নির্ণীতার্থ (যাহার অর্থ নির্ণীত হইয়াছে) বহুবিধ বেদ, তটস্থলক্ষণ (কল্পিত নিদর্শনে প্রকৃত নির্ণয়) ও স্বরূপলক্ষণ (সহজ পরিচয়) দ্বারা উহা নিরূপিত করিয়াছেন। পঞ্চমহাভূত, অহঙ্কার, বুদ্ধি, মূল প্রকৃতি, একাদশ ইন্দ্রিয়, পাঁচ ইন্দ্রিয়বিষয়, ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, শরীর, জ্ঞানাত্নিকা মনোবৃত্তি ও ধৈর্য্য–এই কয়েকটি ক্ষেত্রধর্ম। হে অর্জুন! উক্ত ধর্মবিশিষ্ট ইন্দ্রিয়াদি বিকারশালী ক্ষেত্র সংক্ষেপে কীর্তন করিলাম। অমানিতা, অদাম্ভিকতা, অহিংসা, ক্ষমা, আর্জব, আচার্য্যোপাসনা, শৌচ, স্থৈর্য্য, আত্মসংযম, বিষয়বৈরাগ্য, নিরহঙ্কারিতা এবং জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি, দুঃখ ও দোষের বারংবার সমালোচনা, প্রীতিত্যাগ এবং পুত্র, কলত্র ও গৃহাদির প্রতি অনাসক্ত এবং ইষ্ট ও অনিষ্টাপাতে সমচিত্ততা, আমার প্রতি অব্যভিচারিণী (অনন্যা), ভক্তি, নির্জনে অবস্থান, জনসমাজে বিরাগ, আত্মজ্ঞানপরায়ণতা এবং তত্ত্বজ্ঞানার্থদর্শন (যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানে দৃষ্টি), ইহাই জ্ঞান; ইহার বিপরীত অজ্ঞান।
“এক্ষণে জ্ঞেয় বিষয় কীর্তন করি, শ্রবণ কর। উহা বিদিত হইলে লোকে মোক্ষ প্রাপ্ত হয়। অনাদি ও নির্বিশেষস্বরূপ ব্রহ্মই জ্ঞেয়; তিনি সৎও নহেন, অসৎও নহেন; সর্বত্রই তাহার কর, চরণ, কর্ণ, চক্ষু, মস্তক ও মুখ বিরাজিত আছে। তিনি সকলকে আবৃত করিয়া (সমস্ত ব্যাপিয়া) অবস্থান করিতেছেন। তিনি ইন্দ্রিয়বিহীন, কিন্তু সমস্ত ইন্দ্রিয় ও রূপ, রস প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের গুণ সকল প্রকাশ করেন; তিনি আসক্তিশূন্য ও সকল বস্তুর আধার; তিনি নির্গুণ, কিন্তু সর্বগুণপালক (সকল গুণের পোষক); তিনি চরাচর এবং সকল ভূতের অন্তরে ও বহির্ভাগে অবস্থান করিতেছেন। তিনি অতি সূক্ষ্মত্ব প্রযুক্ত অবিজ্ঞেয়; তিনি অতি সন্নিকৃষ্ট ও দূরবর্তী; তিনি ভূতমধ্যে অবিভক্ত থাকিয়া বিভক্তের ন্যায় অবস্থান করিতেছেন। তিনি ভূতদিগের ভর্তা (প্রভু–পালক), তিনি প্রলয়কালে সমুদয় গ্রাস করেন, সৃষ্টিকালে নানা রূপ পরিগ্রহ করিয়া উৎপন্ন হইয়া থাকেন। তিনি জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর জ্যোতি ও অন্ধকারের অতীত; তিনি জ্ঞান, তিনি জ্ঞেয়, তিনি জ্ঞানপ্রাপ্য। তিনি সকলের হৃদয়ে অবস্থান করিতেছেন। হে অর্জুন! আমি তোমার নিকট ক্ষেত্র, জ্ঞান ও জ্ঞেয়, এই তিনটি সংক্ষেপে কীর্তন করিলাম। আমার ভক্তগণ ইহা অবগত হইয়া আমার ভাব হৃদয়ে বদ্ধমূল করিতে সমর্থ হয়।
“প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়ই অনাদি; দেহ ও ইন্দ্রিয়াদি বিকার এবং সুখ-দুঃখাদি গুণ-সমুদয় প্রকৃতি হইতে সমুদ্ভূত হইয়াছে। শরীর ও ইন্দ্রিয়গণের কর্তৃত্ব-বিষয়ে প্রকৃতি এবং সুখ-দুঃখ-ভোগ -বিষয়ে পুরুষই কারণ বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছেন। পুরুষ দেহে অধিষ্ঠান করিয়া তজ্জনিত সুখ-দুঃখ ভোগ করেন। ইন্দ্রিয়গণের সহিত তাঁহার সম্পর্কই সৎ ও অসৎ যোনিতে জন্মগ্রহণের একমাত্র কারণ তিনি এই দেহে বর্তমান থাকিয়াও দেহ হইতে ভিন্ন; কারণ, তিনি সাক্ষিস্বরূপ, অনুগ্রাহক, বিধানকর্তা, প্রতিপালক, মহেশ্বর ও অন্তর্যামী। যে ব্যক্তি এইরূপে পুরুষ ও সমগ্র গুণের সহিত প্রকৃতিকে অবগত হয়েন, তিনি শাস্ত্রসম্মত পথ (বিধিনিষেধ) অতিক্রম করিলেও মুক্তিলাভ করিয়া থাকেন। কেহ কেহ ধ্যান ও মন দ্বারা দেহমধ্যে আত্মাকে সন্দর্শন করে; কেহ কেহ বা প্রকৃতি-পুরুষের বৈলক্ষণ্যরূপ যোগ দ্বারা, কেহ কেহ বা কর্মযোগ দ্বারা তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ; কেহ কেহ বা আত্মাকে বিদিত না হইয়া অন্যের নিকট উপাসনায় প্রবৃত্ত হয়, সেই সমস্ত শ্রুতিপরায়ণ ব্যক্তিরা মৃত্যুকে অতিক্রম করিয়া থাকে। হে অর্জুন! ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের সংযোগে স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় পদার্থই উৎপন্ন হয়; সেই সমস্ত পদার্থ বিনাশ প্রাপ্ত হইলেও ঈশ্বর কদাচ বিনষ্ট হয়েন না; তিনি সকল ভূতে নির্বিশেষরূপে (তুল্যভাবে) অবস্থান করিতেছেন। যিনি পরমেশ্বরকে ঐরূপ দেখেন, তিনি যথার্থই দেখিয়া থাকেন। লোক-সকল সর্বভূতে সমভাবে অবস্থিত ঈশ্বরকে নিরীক্ষণ করিলে অবিদ্যা দ্বারা আত্মাকে বিনষ্ট করে না; এই নিমিত্ত মোক্ষপদ প্রাপ্ত হয়। প্রকৃতি সর্বপ্রকার কর্মসম্পাদন করেন, কিন্তু আত্মা স্বয়ং কোন কর্ম করেন না; যিনি ইহা সন্দর্শন করিয়াছেন, তিনি সম্যগ্‌দর্শী। যখন লোকে একমাত্র প্রকৃতিতে অবস্থিত ভূতসকলের ভিন্ন ভাব প্রত্যক্ষ করে, তখন সেই প্রকৃতি হইতেই পূর্ণব্রহ্ম প্রাপ্ত হইয়া থাকে। এই অব্যয় পরমাত্মা দেহে অবস্থান করিলেও অনাদিত্ব নির্গুণত্বপ্রযুক্ত কোন ধর্মানুষ্ঠান করেন না এবং কোন প্রকার কর্মফল দ্বারাও কদাচ লিপ্ত হয়েন না। যেমন আকাশ সকল পদার্থে অবস্থান করিলেও কোন পদার্থ দ্বারা উপলিপ্ত হয় না, তদ্রুপ আত্মা সকল দেহে অবস্থান করিলেও দৈহিক গুণ-দোষ দ্বারা কখনই লিপ্ত হয়েন না। হে অর্জুন! যেমন সূর্য একমাত্র হইলেও সমস্ত বিশ্বকে সুপ্রকাশিত করেন, তদ্রুপ একমাত্র আত্মা সমস্ত দেহ প্রকাশিত করিয়া থাকেন। যাহারা জ্ঞানচক্ষু দ্বারা ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের অন্তর (প্রভেদ) এবং ভৌতিক প্রকৃতি হইতে মোক্ষোপায় বিদিত হয়েন, তাঁহারা পরমপদ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন।’ “

চতুর্দশ অধ্যায় – গুণত্রয়বিভাগযোগ
“ভগবান বলিলেন, ‘হে অর্জুন! আমি পুনরায় উৎকৃষ্ট জ্ঞান কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। মহর্ষিগণ ইহা অবগত হইয়া দেহান্তে মোক্ষলাভ করিয়া থাকেন এবং ইহা আশ্রয় করিলে আমার সারূপ্য প্রাপ্য হইয়া সৃষ্টিকালেও জন্মগ্রহণ করেন না ও প্রলয়কালেও ব্যথিত হয়েন না! হে অর্জুন! মহাপ্রকৃতি আমার গর্ভাধানস্থান; আমি তাহাতে সমস্ত জগতের বীজ নিক্ষেপ করিয়া থাকি; তাহাতেই ভূতসকল উৎপন্ন হয়। সমস্ত যোনিতে যে সকল স্থাবরজঙ্গমাত্মক মূর্তি সম্ভূত হয়, মহৎ প্রকৃতি সেই মূর্তি-সমুদয়ের যোনি এবং আমি বীজপ্রদ পিতা। প্রকৃতি-সম্ভূত স্বত্ত্ব, রজঃ ও তম এই তিনটি গুণ দেহের অভ্যন্তরে অব্যয় দেহীকে আশ্রয় করিয়া আছে। তন্মধ্যে সত্ত্ব-গুণ নির্মলত্ব প্রযুক্ত নিতান্ত ভাস্বর (উজ্জ্বল) ও নিরুপদ্রব; এই নিমিত্ত উহা দেবীকে সুখী ও জ্ঞানসম্পন্ন করে। রজোগুণ অনুরাগাত্মক এবং অভিলাষ ও আসক্তি হইতে সমুদ্ভূত; উহা দেবীকে কর্মে নিবন্ধ করিয়া রাখে। সত্ত্বগুণ প্রাণীগণকে সুখে মগ্ন, রজোগুণ কর্মে সংসক্ত এবং তমোগুণ জ্ঞানকে তিরোহিত করিয়া প্রমাদের বশীভূত করে। সত্ত্বগুণ রজঃ ও তমকে, রজোগুন সত্ত্ব ও তমকে, তমোগুণ রজঃ ও সত্ত্বকে অভিভূত করিয়া উদ্ভূত হইয়া থাকে। যখন সত্ত্বগুণ পরিবর্দ্ধ্বিত হয়, তখন এই দেহে সমুদয় ইন্দ্রিয় দ্বারা জ্ঞানরূপ প্রকাশ জন্মে। রজোগুণ প্রবৃদ্ধ হইলে লোভ, প্রবৃদ্ধি, কর্মারম্ভ, স্পৃহা ও অশান্তির সঞ্চার হইয়া থাকে। তমোগুণ প্রবৃদ্ধ হইলে অপ্রকাশ, অপ্রবৃত্তি, প্রমাদ ও মোহ জন্মিয়া থাকে। সত্ত্বগুণ পরিবর্দ্ধিত হইলে যদি কেহ কলেরব পরিত্যাগ করে, সে হিরণ্যগর্ভোপাসকদিগের (ব্রহ্মার উপাসকগণের) প্রকাশময় লোকসকল প্রাপ্ত হয়। রজোগুণ পরিবর্দ্ধিত হইলে যদি কাহারও মৃত্যু হয়, তাহা হইলে কর্মাসক্ত মনুষ্যযোনিতে তাহার জন্ম হইয়া থাকে; আর যদি কেহ তমোগুণ পরিবর্দ্ধিত হইলে দেহ ত্যাগ করে, তাহা হইলে তাহার পশ্বাদিযোনিতে জন্ম হয়। সাত্ত্বিক কর্মের ফল সুনির্মল সাত্ত্বিক সুখ; রাজস কর্মের ফল দুঃখ এবং তামস কর্মের ফল অজ্ঞান। সত্ত্ব হইতে জ্ঞান, রজ হইতে লোভ এবং তম হইতে প্রমাদ, মোহ ও অজ্ঞান সমুত্থিত হইয়া থাকে। সাত্ত্বিক লোক ঊর্দ্ধে ও রাজসিক লোক মধ্যে অবস্থান করেন এবং জঘন্য-গুণসঞ্জাত (নিন্দিত গুণ হইতে জাত) প্রমাদ-মোহাদির বশীভূত তামসিক লোক অধোগতি লাভ করিয়া থাকে। মানব বিবেকী হইয়া গুণসকলকে সমস্ত কার্যের কর্তা বলিয়া নিরীক্ষণ করিলে এবং গুণ হইতে অতিরিক্ত আত্মাকে অবগত হইলে ব্রহ্মত্ব প্রাপ্ত হইয়া থাকে। দেহী দেহসমুদ্ভূত এই তিনটি গুণ অতিক্রম করিয়া জন্ম-মৃত্যু-জরা-জনিত দুঃখ-পরস্পরা হইতে পরিত্রাণ লাভ করিয়া মোক্ষ প্রাপ্ত হয়।’
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! মনুষ্য কোন্‌ সকল চিহ্ন ও কিরূপ আচারসম্পন্ন হইলে এই তিনটি গুণ অতিক্রম করিতে সমর্থ হয়?’
“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে অর্জুন! যিনি প্রকাশ, প্রবৃত্তি ও মোহ স্বতঃ-প্রবৃত্ত হইলে দ্বেষ করেন না, যিনি উদাসীনের ন্যায় আসীন (স্থির) হইয়া সুখ-দুঃখাদি গুণকার্য দ্বারা বিচলিত হয়েন না, প্রত্যুত (বাস্তবিক) গুণসকল স্বকার্যেই ব্যাপৃত আছে, তৎসমুদয়ের সহিত আমার কোন সংস্রব নাই, এইরূপ বিবেচনা করিয়া ধৈর্য অবলম্বন করিয়া থাকেন, যিনি সমদুঃখসুখ, আত্মনিষ্ঠ ও ধীমান্‌, যিনি লোষ্ট্র, প্রস্তর ও কাঞ্চন সমদৃষ্টিতেই দর্শন করেন, যাঁহার প্রিয় ও অপ্রিয় উভয়ই একরূপ, যিনি আত্মনিন্দা, আত্মপ্রশংসা, মান ও অভিমান এবং শত্রু ও মিত্র তুল্যরূপই বিবেচনা করিয়া থাকেন আর যিনি সর্বকর্মত্যাগী (দৃষ্ট ও অদৃষ্টফলজনক কর্মবিষয়ে উদ্যমপরিত্যাগী), তিনিই গুণাতীত। যে ব্যক্তি অসাধারণ ভক্তিযোগ সহকারে আমাকে সেবা করেন, তিনি উক্ত সমস্ত গুণ অতিক্রম করিয়া মোক্ষলাভে সমর্থ হয়েন। হে অর্জুন! আমি ব্রহ্ম, নিত্য, মোক্ষ, শাশ্বত ধর্ম ও অখণ্ড সুখের আস্পদ।’”

পঞ্চদশ অধ্যায় – পুরুষোত্তমযোগ
“ভগবান্‌ বলিলেন, ‘হে অর্জুন! সংসাররূপ এক অব্যয় অশ্বত্থ (সংসারকে অশ্বত্থবৃক্ষে রূপক করা হইয়াছে। ‘শ্ব’ শব্দের অর্থ পরবর্তী প্রভাতকাল। ইহার সহিত স্থিতিবোধক ‘খ’ শব্দযোগে সংসারের অল্পকালস্থায়িত্ব নির্ণীত হইয়াছে; তাহার সহিত আবার অভাবার্থ ‘অ’ যোগ হওয়ায় নিষ্কর্ষার্থ হইয়াছে–অতটুকু অল্পকালও যাহার স্থায়িত্ব নাই। বস্তুতঃ সংসার সেইরূপই ক্ষণভঙ্গুর।) বৃক্ষ আছে, ঊর্দ্ধে উহার মূল এবং অধোদিকে উহার শাখা; বেদসমুদয় উহার পত্র; যিনি এই অশ্বত্থবৃক্ষ বিদিত হইয়াছেন, তিনি বেদবেত্তা। ঐ বৃক্ষের শাখা অধঃ ও ঊর্দ্ধদেশে বিস্তীর্ণ হইয়াছে, উহা সত্ত্বাদিগুণদ্বারা পরিবর্দ্ধিত হইতেছে এবং রূপ, রস প্রভৃতি বিষয়সকল উহার পত্র বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে। ঐ বৃক্ষের ধর্মাধর্মরূপ কর্মপ্রসূতি (কার্য্যপরস্পরা) সকল অধঃপ্রদেশে জীবলোকে বিস্তীর্ণ হইতেছে। এই বৃক্ষের রূপ নিরীক্ষিত (উপলব্ধ–জ্ঞানের বিষয়ীভূত) হয় না; ইহার আদি নাই, অন্ত নাই এবং ইহা কিরূপে অবস্থান করিতেছে, তাহাও অবগত হওয়া যায় না। এই বদ্ধমূল অশ্বত্থবৃক্ষ সুদৃঢ় নির্মমত্বরূপ (মমতাশূন্যরূপ) শস্ত্রদ্বারা ছেদন করিয়া উহার মূলীভূত বস্তু অনুসন্ধান করিবে। উহা প্রাপ্ত হইলে পুনরায় প্রত্যাবৃত্ত হইতে হয় না। ‘যাঁহা হইতে এই চিরন্তনী (অনন্তকালস্থায়ী) সংসারপ্রবৃত্তি বিস্তৃত হইয়াছে, আমি সেই আদিপুরুষের শরণাপন্ন হই,’ এই বলিয়া তাঁহার অনুসন্ধান করিয়ে হইবে। যাঁহারা অভিমান, মোহ ও পুত্রকলত্রাদির প্রতি আসক্তি পরিত্যাগ করিয়াছেন এবং সুখ ও দুঃখ হইতে বিমুক্ত হইয়াছেন, সেই সমস্ত আত্মজ্ঞানপরায়ণ, নিষ্কাম, অবিদ্যাশূন্য মহাত্মারা অব্যয় পদ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। যাহা প্রাপ্ত হইলে পুনর্বার প্রতিনিবৃত্ত হইতে হয় না; চন্দ্র, সূর্য্য ও হুতাশন যাঁহাকে প্রকাশিত করিতে সমর্থ হয়েন না; তাহাই আমার পরম পদ। এই জীবলোকে সনাতন জীব আমারই অংশ, ইনি প্রকৃতিবিলীন (প্রকৃতিতে লয়প্রাপ্ত) পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মনকে আকর্ষণ করেন। যেমন বায়ু কুসুমাদি হইতে গন্ধ গ্রহণপূর্বক গমন করিয়া থাকে, সেইরূপ যখন জীব শরীর লাভ ও শরীর পরিত্যাগ করে, তখন পূর্বদেহ হইতে ইন্দ্রিয়সমুদয় গ্রহণপূর্বক গমন করিয়া থাকে। এই জীব শ্রোত্র (কর্ণ), চক্ষু, ত্বক্‌, রসনা, ঘ্রাণ ও মনোমধ্যে অধিষ্ঠিত হইয়া বিষয়সমুদয় উপভোগ করে। বিমূঢ় ব্যক্তিরা দেহান্তরগামী, দেহাবস্থিত বা রূপাদি বিষয়ের উপভোগে লিপ্ত, ইন্দ্রিয়যুক্ত জীবকে কদাচ নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হয় না; জ্ঞানচক্ষুঃসম্পন্ন মহাত্মারাই উহা অবলোকন করিয়া থাকেন। যোগী ব্যক্তিগণ যত্নবান হইয়া দেহে অবস্থিত জীবকে সন্দর্শন করিতে পারে না। চন্দ্র, অনল ও নিখিল ভুবনবিকাশী (বিশ্বের প্রকাশকর) সূর্য্য আমারই তেজে তেজস্বী। আমি ওজঃপ্রভাবে (তেজোযুক্ত শক্তি প্রভাবে) পৃথিবীতে প্রবেশ করিয়া ভূতসকলকে ধারণ এবং রসাত্মক চন্দ্র হইয়া ওষধিসমুদয়ের (বৃক্ষলতাদি) পুষ্টিসাধন করি। আমি জঠরাগ্নি (উদরস্থ পাকাগ্নি) হইয়া প্রাণ ও অপান বায়ুসমভিব্যাহারে দেহমধ্যে প্রবেশপূর্বক চতুর্বিধ ভক্ষ্য পাক করিয়া থাকি।
” ‘আমি সকলের হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া আছি, আমা হইতেই স্মৃতি, জ্ঞান ও উভয়ের অভাব জন্মিয়া থাকে। আমি চারিবেদদ্বারা বিদিত হই এবং আমি বেদান্তকর্তা ও বেদবেত্তা। ক্ষর ও অক্ষর এই দুইটি পুরুষ লোকে প্রসিদ্ধ আছে, তন্মধ্যে সমুদয় ভূতই ক্ষর ও কূটস্থ পুরুষ অক্ষর। ইহা ভিন্ন অন্য একটি উত্তম পুরুষ আছেন, তাঁহার নাম পরমাত্মা; এই অব্যয় পরমাত্মা ত্রিলোকমধ্যে প্রবেশ করিয়া সমস্ত প্রতিপালন করিতেছেন। আমি ক্ষর ও অক্ষর, এই দুই প্রকার পুরুষ অপেক্ষা উত্তম, এই নিমিত্ত বেদ ও লোকমধ্যে পুরুষোত্তম বলিয়া কীর্তিত হইয়া থাকি। যে ব্যক্তি মোহশূন্য হইয়া আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া বিদিত হয়, সেই সর্ববেত্তা, সর্বপ্রকারে আমার আরাধনা করে। হে অর্জুন! আমি এই পরম গুহ্য শাস্ত্র কীর্তন করিলাম, ইহা বিদিত হইলে লোক বুদ্ধিমান ও কৃতকার্য্য হয়।’

ষোড়শ অধ্যায় – দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ
“ভগবান বলিলেন, ‘হে অর্জুন! যাহারা দৈবসম্পদ্‌ লক্ষ্য করিয়া জন্মগ্রহণ করে, তাহারা অভয়, চিত্তশুদ্ধি, আত্মজ্ঞানোপায়ে (আত্মজ্ঞানসাধনে) পরনিষ্ঠা (ঐকান্তিকভাব), দান, দম, যজ্ঞ, স্বাধ্যায়, তপ, ঋজুতা, অহিংসা, সত্য, অক্রোধ, ত্যাগ, শান্তি, অখলতা, প্রাণীর প্রতি দয়া, অলোলুপতা (নির্লোভতা), মৃদুতা, হ্রী, অচপলতা (অচাঞ্চল্য), তেজ, ক্ষমা, ধৃতি, শৌচ, অদ্রোহ ও অনভিমানিতা এই ষড়বিংশতি গুণপ্রাপ্ত হইয়া তাহারা দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা ও অজ্ঞানে অভিভূত হয়। দৈবসম্পদ লক্ষ্য করিয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছ, অতএব শোক করিও না।
“‘হে অর্জুন! ইহলোকের দৈব ও আসুর এই দুই প্রকার ভূত সৃষ্ট হইয়াছে; দৈব বিষয় বিস্তারিতরূপে কহিয়াছি; এক্ষণে আসুর বিষয় কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। আসুরভাব লোক সকল ধর্মে প্রবৃত্তি ও অধর্ম হইতে নিবৃত্তির বিষয় অবগত নহে; তাহাদিগের শৌচ নাই, আচার নাই ও সত্য নাই; তাহারা জগৎকে সত্য ও ধর্মাধর্ম ব্যবস্থাবর্জিত, ঈশ্বরশূন্য, ধর্মাধর্মাবাসনাবশে অনুৎপন্ন কেবল কেমহেতুক স্ত্রী-পুরুষ সম্ভূত কহে। সেই সকল অল্পবুদ্ধি লোক এইরূপ জ্ঞান আশ্রয় করিয়া মিলনচিত্ত, উগ্রকর্মা ও অহিতকারী হইয়া জগতের ক্ষয়ের নিমিত্ত সমুদ্ভূত হয়; দম্ভ, অভিমান, মদ, অশুচিব্রত (অপবিত্র কার্য্য) ও দুষ্পূরণীয় কামনা অবলম্বন এবং মোহবশতঃ অসৎ প্রতিগ্রহ করিয়া ক্ষুদ্র দেবতার আরাধনায় প্রবৃত্ত হয়; আমরণ অপরিমেয় চিন্তাকে আশ্রয় করিয়া থাকে; কামোপভোগই পরম পুরুষার্থ বলিয়া নিশ্চয় করে; শত শত আশাপাশে বদ্ধ ও কামক্রোধের বশীভূত হইয়া কামভোগার্থ অন্যায়পূর্বক অর্থসঞ্চয়ের চেষ্টা করে; আজি আমার এই মনোরথ পূর্ণ হইল ও এই মনোরথ পরিপূর্ণ হইবে, আমি এই শত্রুকে বিনাশ করিয়াছি, অন্য শত্রুকেও বিনাশ করিব, আমি ঈশ্বর, আমি ভোগী, আমি সিদ্ধ, আমি বলবান, আমি সুখী, আমি যাগ করিব, দান করিব ও আমোদ করিব, এই প্রকার অজ্ঞানে বিমোহিত, অনেকবিধ চিত্তবিভ্রম ও মোহজালে আচ্ছন্ন এবং কামভোগে আসক্ত হইয়া অতি কুৎসিত নরকে নিপতিত হয়। অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম, ক্রোধ ও অসূয়া আশ্রয় করিয়া আপনার ও পরের দেহে আমার দ্বেষ করে এবং আপনা আপনি সম্মানিত, অহঙ্কৃত ও ধন-মান-মদে প্রমত্ত হইয়া দম্ভসহকারে অবিধিপূর্বক নামমাত্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে। আমি সেই সমস্ত দ্বেষপরবশ, ক্রুর-স্বভাব, অশুভকারী নরাধমকে নিরন্তর সংসারে আসুরযোনিমধ্যে নিক্ষেপ করি। তাহারা আসুরযোনি প্রাপ্ত হইয়া আমাকে লাভ করিতে পারে না, সুতরাং অধম গতি প্রাপ্ত হইয়া থাকে।
“‘কাম, ক্রোধ ও লোব, নরকের এই ত্রিবিধি দ্বার। অতএব এই তিনটি পরিত্যাগ করিবে। যে ব্যক্তি নরকের এই ত্রিবিধি দ্বার হইতে মুক্ত হইয়াছেন, তিনি আপনার কল্যাণ আচরণ করেন এবং তৎপরে পরমগতি প্রাপ্ত হয়েন। যে ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচারে প্রবৃত্ত হয়, সে সিদ্ধি প্রাপ্ত হয় না, সুখ প্রাপ্ত হয় না ও পরম গতি প্রাপ্ত হয় না। অতএব কার্য্যাকার্য্য-ব্যবস্থা-বিষয়ে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ। তুমি শাস্ত্রোক্ত কর্ম অবগত হইয়া তাহার অনুষ্ঠান কর।’”

সপ্তদশ অধ্যায় – শ্রদ্ধাত্রয়বিভাগযোগ
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! যাহারা শাস্ত্রবিধি পরিত্যাগ করিয়া শ্রদ্ধাসহকারে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে, তাহাদের শ্রদ্ধা সাত্ত্বিক কি রাজসিক অথবা তামসিক?’
“কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে অর্জুন! দেহিগণের স্বাভাবিক শ্রদ্ধা তিন প্রকার;–সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। তাহাদের বিবরণ শুন। সকলের শ্রদ্ধাই সত্ত্বগুণের অনুযায়িনী, পুরুষও সত্ত্বময়; তন্মধ্যে পূর্বে যিনি যেরূপ শ্রদ্ধাবান ছিলেন, পরেও সেইরূপ শ্রদ্ধাবান হইবেন। সাত্ত্বিক লোক দেবগণের, রাজসিকেরা যক্ষ ও রক্ষোগণের এবং তামসিকগণ ভূত ও প্রেতসমূহের পূজা করিয়া থাকে।
“‘যে সকল হীনচেতাঃ ব্যক্তি দম্ভ, অহঙ্কার, কাম, রাগ ও বলসম্পন্ন হইয়া শরীরস্থ ভূতগণকে ক্লেশিত করিয়া অশাস্ত্রবিহিত ঘোরতর তপস্যা করে, তাহারা আমাকেই ক্লেশিত করিয়া থাকে। তাহাদিগকে অতিশয় ক্ররস্বভাব বলিয়া জানিবে। সকলের প্রীতিকর আহার তিন প্রকার, যজ্ঞ তিন প্রকার, তপ তিন প্রকার এবং দান তিন প্রকার; তাহাদের এই প্রভেদ শুন। আয়ুঃ, উৎসাহ, বল, আরোগ্য, সুখ ও রুচিবর্দ্ধন, রস ও স্নেহযুক্ত, দীর্ঘকাল স্থায়ী, মনোহর আহার সাত্ত্বিকদিগের প্রীতিকর। অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবন, অত্যুষ্ণ, অতি তীক্ষ্ণ, অতি রুক্ষ, অতি দাহী এবং দুঃখ, শোক ও রোগপ্রদ আহার রাজসিকগণের অভিলষিত এবং বহুক্ষণে পক্ক, গতরস, দুর্গন্ধ, পর্য্যুষিত, উচ্ছিষ্ট, অপবিত্র ভোজ্য তামসদিগের প্রীতিকর।
“‘ফলাকাঙ্খাশূন্য ব্যক্তিরা একাগ্রমনে কেবল কেবল কর্তব্য জ্ঞানে যে অবশ্য-কর্তব্য যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, তাহাই সাত্ত্বিক। হে অর্জুন! ফললাভ বা মহত্বপ্রকাশের নিমিত্ত যে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়ম তাহাই রাজসিক। বিধি, অন্নদান, মন্ত্র, দক্ষিণা ও শ্রদ্ধাশূন্য যজ্ঞ তামসিক বলিয়া কীর্তিত হয়।
“‘দেব, দ্বিজ, গুরু ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তির পূজা, শুচিতা, ঋজুতা, ব্রহ্মচর্য্য ও অহিংসা শারীরিক তপঃ; অভয়, সত্য, প্রিয় ও হিতকর বাক্য এবং বেদাভ্যাস বাঙ্ময় তপ; চিত্তশুদ্ধি, অক্রুরতা, মৌন, আত্মনিগ্রহ (ইন্দ্রিয়সংযম) ও ভাবশুদ্ধি মানসিক তপ। ফলকামনা পরিত্যগা করিয়া পরম শ্রদ্ধা সহকারে যে তপ অনুষ্ঠিত হয়, তাহাই সাত্ত্বিক; সৎকার, মান, পূজা, লাভ ও দম্ভ প্রকাশের নিমিত্ত অনুষ্ঠিত তপ রাজসিক, এই তপস্যা অনিয়ত (নিয়মরহিত–বিধিনিষেধের অননুমোদিত) ও ক্ষণিক। যে তপস্যা দুরাগ্রহ (দুরভিসন্ধি-প্রণোদিত) ও আত্মপীড়া দ্বারা অথবা অন্যের উৎসাদনার্থ (উচ্ছেদের জন্য) অনুষ্ঠিত হয়, তাহাই তামসিক।
“‘কেবল দাতব্য জ্ঞানে দেশ, কাল ও পাত্র বিবেচনা করিয়া অনুপকারী ব্যক্তির প্রতি যে দান, তাহাই সাত্ত্বিক; প্রত্যুপকার বা স্বর্গাদির উদ্দেশে ক্লেশসহকারে যে দান অনুষ্ঠিত হয়, তাহাই রাজসিক; অনুপযুক্ত স্থানে, অনুপযুক্ত কালে ও অনুপযুক্ত পাত্রে সৎকারবর্জিত তিরস্কারসহকৃত যে দান, তাহাই তামসিক।
“‘ব্রহ্মের নাম তিন প্রকার; ওঁ, তৎ ও সৎ; পূর্বে এই ত্রিবিধ নাম দ্বারা ব্রাহ্মণ, বেদ ও যজ্ঞ সৃষ্ট হইয়াছিল; এই নিমিত্ত ব্রহ্মবাদীদিগের বিধানোক্ত যজ্ঞ, দান ও তপ ওঁকার উচ্চারণপূর্বক অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে। মুমুক্ষু ব্যক্তিগণ ফলাভিসন্ধি পরিত্যাগ করিয়া ‘তৎ’ উচ্চারণপূর্বক নানাবিধ যজ্ঞ, তপ ও দানক্রিয়ার অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। হে অর্জুন! অস্তিত্ব, সাধুত্ব ও মঙ্গলকর্মে সৎ শব্দ প্রযুক্ত হইয়া থাকে। যজ্ঞ, তপ ও দান এবং ঈশ্বরোদ্দেশে অনুষ্ঠিত কর্মও সৎ শব্দে অভিহিত হয়। অশ্রদ্ধাসহকৃত হোম, দান, তপস্যা ও অন্যান্য কর্ম অসৎ বলিয়া নির্দিষ্ট হয়। তৎসমুদয় ইহলোকে বা পরলোকে সফল হয় না।’”

অষ্টাদশ অধ্যায় – মোক্ষযোগ
“অর্জুন কহিলেন, ‘মহাবাহো! আমি সন্ন্যাস ও ত্যাগের প্রকৃত তত্ত্ব পৃথকরূপে শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি, তুমি তাহা কীর্তন কর।’
“বাসুদেব কহিলেন, ‘হে অর্জুন! পণ্ডিতেরা কাম্যকর্মের ত্যাগকেই সন্ন্যাস এবং সকল প্রকার কর্মফল ত্যাগকেই ত্যাগ কহিয়া থাকেন। কেহ কেহ কহেন, ক্রিয়াকলাপ দোষের ন্যায় পরিত্যাগ করা বিধেয়। অন্যেরা কহিয়া থাকেন, যজ্ঞ, দান ও তপস্যা এই কএকটি কার্য্য কোনরূপেই পরিত্যগা করা কর্তব্য নহে। এক্ষণে প্রকৃত ত্যাগ কিরূপ, তুমি তাহা শ্রবণ কর। তামসাদিভেদে ত্যাগ তিন প্রকার। যজ্ঞ, দান ও তপস্যা কদাচ ত্যাগ করা কর্তব্য নহে, ইহার অনুষ্ঠান করাই শ্রেয়স্কর। এই কয়েকটি কার্য্য বিবেকীদিগের চিত্তশুদ্ধির কারণ। হে পার্থ! আমার নিশ্চিত মত এই যে, আসক্তি ও কর্মফল পরিত্যাগ করিয়া এই সমস্ত কার্য্য অনুষ্ঠান করাই শ্রেয়ঃ।
“‘নিত্যকর্ম পরিত্যাগ করা কর্তব্য নহে; কিন্তু মোহবশতঃ যে নিত্যকর্মত্যাগ, তাহা তামস বলিয়া পরিকীর্তিত হয়। নিতান্ত দুঃখজনক বলিয়া কায়ক্লেশ ও ভয়প্রযুক্ত যে কর্ম পরিত্যাগ করা, তাহা রাজস ত্যাগ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। রাজসত্যাগী পুরুষ ত্যাগফললাভে সমর্থ হয় না। আসক্তি ও কর্মফল পরিত্যাগ করিয়া কর্তব্যবোধে যে কর্মানুষ্ঠান, তাহা সাত্ত্বিক ত্যাগ বলিয়া উক্ত হইয়া থাকে। সত্ত্বগুণসম্পন্ন মেধাবী ও সংশয়রহিত ত্যাগী ব্যক্তি দুঃখাবহ বিষয়ে দ্বেষ ও সুখাবহ বিষয়ে অনুরাগ প্রদর্শন করেন না। দেহী নিঃশেষে সমস্ত কার্য্য পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হয় না; কিন্তু যিনি কর্মফলত্যাগী, তাঁহাকেই ত্যাগী বলা যাইতে পারে। কর্মের ইষ্ট, অনিষ্ট, ইষ্টানিষ্ট এই ত্রিবিধ ফল অভিহিত হইয়া থাকে। যাঁহারা ত্যাগী নহেন, তাঁহারা পরলোক প্রাপ্ত হইলে ঐ সমস্ত হলে লাভ করেন। কিন্তু সন্যাসীরা উহা লাভ করিতে কদাচ সমর্থ হয়েন না। হে অর্জুন! সকল কর্মের সিদ্ধি-বিষয়ে কর্মবিধিশূন্য বেদান্তসিদ্ধান্তে শরীর, কর্তা, পৃথকবিধকরণ (বিভিন্ন উপাদান–উপকরণ), পৃথক পৃথক চেষ্টা ও দৈব এই পাঁচ প্রকার নির্দিষ্ট আছে। ন্যায্য বা অন্যায্যই, মনুষ্য কায়, মন ও বাক্য দ্বারা যে কার্য্য অনুষ্ঠান করে, এই পাঁচটিই তাহার কারণ; এই কারণ অবধারিত হইলে যে অসংস্কৃত বুদ্ধি বশতঃ নিরুপাধি আত্মার ক্ররতৃত্ব নিরীক্ষণ করে, সেই দুর্মতি কখন সাধুদর্শী নহে। যিনি আপনাকে কর্তা বলিয়া মনে করেন না, যাঁহার বুদ্ধি কার্য্যে আসক্ত হয় না, তিনি লোক-সমুদয়কে বিনষ্ট করিয়াও বিনাশ করেন না এবং তাঁহাকে বিনাশজনিত ফলভোগও করিতে হয় না। জ্ঞান, জ্ঞেয় ও পরিজ্ঞাতা (জ্ঞানের উদ্বোধক) কর্মে প্রবৃত্তিসম্পাদনের হেতু; আর কারণ, কর্ম ও কর্তা ক্রিয়ার আশ্রয় হইয়া থাকে। সাঙ্খ্য শাস্ত্রে জ্ঞান, কর্ম, ও কর্তা প্রত্যেকে সত্ত্বাদি গুণভেদে তিন প্রকার নির্দিষ্ট হইয়াছে। হে অর্জুন! আমি এক্ষণে তাহা কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
“‘লোকে যে জ্ঞান দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন ভূতগণের মধ্যে অভিন্নরূপে অবস্থিত ও অব্যয় পরমাত্মতত্ত্ব প্রত্যক্ষ করে, তাহাই সাত্ত্বিক জ্ঞান। যে জ্ঞান দ্বারা পৃথক পৃথক পদার্থ পৃথকরূপে জ্ঞাত হওয়া যায়, তাহা রাজসিক জ্ঞান আর একমাত্র প্রতিমাদিতে ঈশ্বর পূর্ণরূপে বিদ্যমান আছেন, এইরূপ অবাস্তবিক (কাল্পনিক–অপ্রকৃত) অযৌক্তিক তুচ্ছ জ্ঞান তামসিক বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে।
“‘কর্তৃত্বাভিমান বিরহিত নিষ্কাম ব্যক্তি কর্তৃক অনুরাগ ও বিদ্বেষ পরিত্যাগপূর্বক অনুষ্ঠিত নিত্য কর্মই সাত্বিক; সকাম ও অহঙ্কারপরতন্ত্র ব্যক্তি কর্তৃক অনুষ্ঠিত বহুল আয়াসকর কর্ম রাজসিক। আর ভাবী শুভাশুভ, বিত্তক্ষয়, হিংসা ও পৌরুষ পর্য্যালোচনা না করিয়া মোহবশতঃ যে কার্য্য অনুষ্ঠিত হয়, তাহাই তামসিক।
“‘অনাসক্ত, নিরহঙ্কার, ধৈর্য্য ও উৎসাহসম্পন্ন এবং সিদ্ধি ও অসিদ্ধিবিষয়ে বিকারবিরহিত কর্তাই সাত্ত্বিক; অনুরাগপরায়ণ, কর্মফলপ্রার্থী, লুব্ধপ্রকৃতি, হিংস্রক, অশুচি ও হর্ষশোকসন্বিত কর্তাই রাজসিক। আর অনবহিত (অনভিনিবিষ্ট–অসাবধান) বিবেকবিহীন, উদ্ধত, শঠ, পরাবমানী (পরের অপমানকারী), অলস, বিষাদযুক্ত ও দীর্ঘসূত্রী (চিরক্রিয়–আজ কাল করিয়া যে কার্য্যে বিলম্ব করে) কর্তাই তামসিক।
“‘হে অর্জুন! গুণানুসারে বুদ্ধি ও ধৈর্য্যের ত্রিবিধ ভেদ নির্দিষ্ট হইয়া থাকে; আমি উহা সম্যকরূপে পৃথক পৃথক কীর্তন করিতেছি, তুমি তাহা শ্রবণ কর। যে বুদ্ধি দ্বারা প্রবৃত্তি, নিবৃত্তি, কার্য্য, অকার্য্য, ভয়, অভয়, বন্ধ ও মোক্ষ অবগত হওয়া যায়, তাহা সাত্ত্বিকী; যে বুদ্ধি দ্বারা ধর্ম, অধর্ম, কার্য্য ও অকার্য্য প্রকৃতরূপে অবগত হওয়া যায় না, তাহা রাজসী; আর যে বুদ্ধি অজ্ঞানান্ধকারাচ্ছন্ন (অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে আবৃত) হইয়া অধর্মকে ধর্ম ও সমস্ত পদার্থ বিপরীতরূপে প্রতিপন্ন করে, তাহা তামসী।
“‘যে ধৃতি চিত্তের একাগ্রতা নিবন্ধন জন্য বিষয় ধারণ না করিয়া মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়ের কার্য্য-সমুদয় ধারণ করে, তাহা সাত্ত্বিকী। যে ধৃতি প্রসঙ্গতঃ ফললাভের অভিসন্ধি করিয়া থাকে, তাহা রাজসী। আর অবিবেচক পুরুষ যাহার প্রভাবে স্বপ্ন, ভয়, শোক, বিষাদ ও গর্ব পরিত্যাগ করিতে পারে না, তাহাই তামসী ধৃতি।
“‘হে অর্জুন! যে সুখে অভ্যাস বশতঃ আসন্ত হইতে হয় এবং যাহা লাভ করিলে দুঃখের অবসান হইয়া থাকে, এক্ষণে সেই ত্রিবিধ সুখের বিষয় কীর্তন করি, শ্রবণ কর। যাহা অগ্রে বিষের ন্যায় ও পরিণামে অমৃতের ন্যায় প্রতীয়মান হয় এবং যদ্দ্বারা আত্মবিষয়িণী বুদ্ধির প্রসন্নতা জন্মে, তাহা সাত্ত্বিক সুখ; বিষয় ও ইন্দ্রিয়াদির সংযোগ বশতঃ যাহা অগ্রে অমৃততুল্য, পরিবেশে বিষতুল্য প্রতীয়মান হয়, তাহা রাজস সুখ; আর যে সুখ অগ্রে এবং পশ্চাতে আত্মার মোহ সম্পাদন করে, যাহা নিদ্রা, আলস্য ও প্রামাদ হইতে সমুত্থিত হয়, তাহা তামসিক সুখ। পৃথিবী বা স্বর্গে এই স্বাভাবিক গুণত্রয়-বিরহিত কোন প্রাণী কদাচ দৃষ্টিগোচর হয় না। এই স্বভাবপ্রভব গুণত্রয় দ্বারা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদিগের কর্মসমুদয় বিভক্ত হইয়াছে। শম, দম, শৌচ, ক্ষমা, আর্জব, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আস্তিক্য, এই কয়েকটি ব্রাহ্মণের স্বাভাবিক কর্ম। শৌর্য্য, তেজ, ধৃতি, দক্ষতা, সমরে অপরাঙ্মুখতা, দান ও ঈশ্বরভাব এই কয়েকটি ক্ষত্রিয়দিগের স্বাভাবিক কর্ম। কৃষি, গোরক্ষণ ও বাণিজ্য এই কয়েকটি বৈশ্যের স্বাভাবিক কার্য্য এবং একমাত্র পরিচর্য্যাই শূদ্রজাতির স্বাভাবিক কার্য্য। মানুষ স্ব স্ব কর্মনিরত হইয়া সিদ্ধি লাভ করিয়া থাকে। এক্ষণে স্বকর্মনিরত ব্যক্তিদিগের যেরূপ সিদ্ধিলাভ হয়, তাহা শ্রবণ কর। যাঁহা হইতে সকলের প্রবৃতি প্রাদুর্ভূত হইতেছে, যিনি এই বিশ্বসংসারে ব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছেন, মনুষ্য স্বকর্ম দ্বারা তাঁহাকে অরচনা করিয়া সিদ্ধি লাভ করিয়া থাকে। সম্যক অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা অঙ্গহীন স্বধর্মই শ্রেষ্ঠ; কেন না, স্বভাববিহিত কার্য্য অনুষ্ঠান করিলে দুঃখভোগ করিতে হয় না। হে অর্জুন! যেমন ধূমরাশি দ্বারা হুতাশন সমাচ্ছন্ন থাকে, তদ্রুপ সমস্ত কার্য্যই দোষ দ্বারা সংস্পৃষ্ট আছে; অতএব স্বাভাবিক কার্য্য দোষযুক্ত হইলেও কদাচ পরিত্যাগ করিবে না। আসক্তিবিবর্জিত, জিতেন্দ্রিয় ও স্পৃহাশূন্য মনুষ্য সন্ন্যাস দ্বারা সর্বকর্মনিবৃত্তিরূপ সত্ত্বশুদ্ধি প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। হে পার্থ; সিদ্ধ পুরুষ যাহাতে ব্রহ্ম প্রাপ্ত হয়েন, এক্ষণে সেই জ্ঞাননিষ্ঠার বিষয় সংক্ষেপে কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। মনুষ্য বিশুদ্ধ বুদ্ধিসংযুক্ত হইয়া ধৈর্য্য দ্বারা বুদ্ধি সংযত করিবে; শব্দাদি বিষয়ভোগ পরিত্যাগ করিয়া রাগ ও দ্বেষ-বিরহিত হইবে; বাক্য, কায় ও মনোবুদ্ধি সংযত করিয়া বৈরাগ্য আশ্রয়, ধ্যান ও যোগানুষ্ঠানপূর্বক লঘু আহার ও নির্জনে বাস করিবে; অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম, ক্রোধ ও পরিগ্রহ (প্রতিগ্রহ–অর্থাদি গ্রহণ) পরিত্যাগপূর্বক মমতাশূন্য হইয়া শান্তভাব অবলম্বন করিবে। এইরূপ অনুষ্ঠান করিলে তিনি ব্রহ্মে অবস্থান করিতে সমর্থ হইবেন। তিনি ব্রহ্মে অবস্থিত ও প্রসন্নচিত্ত হইয়া শোক ও লোভের বশীভূত হয়েন না; সকল প্রাণীর প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন হয়েন এবং আমার প্রতিও তাঁহার দৃঢ়ভক্তি জন্মে। তিনি ভক্তিপ্রভাবে আমার স্বরূপ ও আমার সর্বব্যাপিত্ব সম্যক অবগত হইয়া পরিণামে আমাতেই প্রবেশ করেন। লোকে আমাকে আশ্রয় করিয়া কর্মসমুদয় অনুষ্ঠান করিয়া আমারই অনুকম্পায় অব্যয় শাশ্বত পদ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। হে অর্জুন! তুমি মনোবৃত্তি দ্বারা সমস্ত কর্ম আমাতে অবলম্বন করিয়া সতত আমাতে চিত্ত সমর্পণ কর; তাহা হইএল তুমি আমার অনুগ্রহে দুস্তর দুঃখসকল উত্তীর্ণ হইতে সমর্থ হইবে; কিন্তু যদি অহঙ্কারপরতন্ত্র হইয়া আমার বাক্য শ্রবণ না কর, তাহা হইলে নিঃসন্দেহে বিনাশ প্রাপ্ত হইবে। যদি তুমি অহঙ্কারপ্রযুক্ত ‘যুদ্ধ করিব না’। এইরূপ অধ্যবসায় করিয়া থাক, তাহা হইলে উহা নিতান্ত নিষ্ফল; কারণ, প্রকৃতিই তোমাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করিবে। হে অর্জুন! তুমি মোহবশতঃ এক্ষণে যে কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতেছ না, তোমাকে ক্ষত্রিয়সুলভ শূরতার (শৌর্য্যের–বীরত্বের) বশীভূত হইয়া তাহা অবশ্যই অনুষ্ঠান করিতে হইবে। যেমন সূত্রধার দারুযন্ত্রে আরূঢ় কৃত্রিম ভূতসকলকে ভ্রমণ করাইয়া থাকে, তদ্রুপ ঈশ্বর ভূতসকলের হৃদয়ে অবস্থান করিয়া তাহাদিগকে ভ্রমণ করাইতেছেন। এক্ষণে তুমি সকল বিষয়ে তাঁহারই শরণাপন্ন হও; তাঁহার অনুকম্পায় পরম শান্তি ও শাশ্বত স্থান প্রাপ্ত হইবে।
“‘হে অর্জুন! আমি এই পরম গুহ্যজ্ঞানের বিষয় কীর্তন করিলাম, এক্ষণে ইহা সম্যক আলোচনা করিয়া যেরূপ অভিলাষ হয়, তাহার অনুষ্ঠান কর। তুমি আমার একান্ত প্রিয়; এই নিমিত্ত তোমাকে পুনরায় পরম গুহ্য হিতকর বাক্য কহিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি আমাতে চিত্ত সমর্পণ এবং আমার প্রতি ভক্তিপরায়ণ হইয়া আমার উদ্দেশে যজ্ঞানুষ্ঠান ও আমাকে নমস্কার কর। তুমি আমার অতিশয় প্রিয়পাত্র, এই নিমিত্ত অঙ্গীকার করিতেছি, তুমি আমাকে অবশ্যই প্রাপ্ত হইবে। তুমি সমস্ত ধর্মানুষ্ঠান পরিত্যাগ করিয়া একমাত্র আমারই শরণাপন্ন হও; আমি তোমাকে সকল পাপ হইতে বিমুক্ত করিব। এক্ষণে তুমি আর শোকাকুল হইও না।
“‘আমি তোমাকে যে সকল উপদেশ প্রদান করিলাম, তুমি ইহা ধর্মানুষ্ঠানশূন্য, ভক্তিবিহীন ও শুশ্রূষাবিরহিত ব্যক্তিকে বিশেষতঃ যে লোক আমার প্রতি অসূয়াপরবশ হইয়া থাকে, তাহাকে কদাচ শ্রবণ করাইও না। যে ব্যক্তি ভক্তিপরায়ণ হইয়া আমার ভক্তগণের নিকট এই পরম গুহ্য বিষয়ে কীর্তন করিবেন, তিনি নিঃসন্দেহ আমাকে প্রাপ্ত হইবেন, এই নরলোকে তাঁহা অপেক্ষা আমার প্রিয়কারী ও প্রিয়তম আর হইবে না। যে ব্যক্তি আমাদিগের এই ধর্মানুগত সংবাদ অধ্যয়ন করিবে, তাহার জ্ঞানযজ্ঞ দ্বারা আমারই অর্চনা করা হইবে। যে মনুষ্য অসূয়াপরবশ না হইয়া পরম শ্রদ্ধা সহকারে এই সংবাদ শ্রবণ করিবে, সে সর্বপাপবিমুক্ত হইয়া পুণ্যকর্মাদিগের শুভলোকসকল প্রাপ্ত হইবে। হে ধনঞ্জয়! তুমি কি একাগ্রমনে এ সংবাদটি শ্রবণ করিলে? এবং ইহা দ্বারা কি তোমার অজ্ঞানজনিত মোহ অবগত হইল?’
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! তোমার অনুগ্রহে মোহান্ধকার নিরাকৃত (অপগত–দূরীকৃত) হওয়াতে আমি স্মৃতি লাভ করিয়াছি, আমার সকল সন্দেহই দূর হইয়াছে, এক্ষণে তুমি যাহা কহিলে, আমি অবশ্যই তাহার অনুষ্ঠান করিব।’”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আমি বাসুদেব ও অর্জুনের এইরূপ অদ্ভূত ও লোমহর্ষণ কথোপকথন শ্রবণ করিলাম। ব্যাসদেবের অনুগ্রহে সাক্ষাৎ যোগেশ্বর কৃষ্ণের মুখে এই পরম গুহ্যযোগ শ্রবণ করিয়াছি। হে রাজন! কৃষ্ণ ও অর্জুনের এই পবিত্র ও অদ্ভূত সংবাদ যতই স্মরণ করিতেছি, ততই পুনঃ পুনঃ হৃষ্ট ও সন্তুষ্ট হইতেছি। আমি বাসুদেবের সেই অলৌকিক রূপ বারংবার স্মরণপূর্বক পুনঃ পুনঃ বিস্ময় ও হর্ষসাগরে ভাসমান হইতেছি; এক্ষণে আমার বোধ হইতেছে, যে পক্ষে বাসুদেব ও অর্জুন অবস্থান করিতেছেন, তাঁহাদিগেরই রাজ্যলক্ষ্মী জয়, অদ্ভুদয় ও নীতি লাভ হইবে।”
বৈশম্পায়ন কহিলেন,–পদ্মনাভ ভগবান বাসুদেবের নিজ মুখপদ্ম হইতে যাহা বিনিঃসৃত, একমাত্র সেই গীতাই উত্তমরূপে পাঠ করা কর্তব্য; অন্যান্য শাস্ত্র পাঠের আর আবশ্যক কী? কারণ, গীতা সর্বশাস্ত্রময়ী, হরি, সর্বদেবময়, গঙ্গা সর্বতীর্থময়ী, মন্ত্র সমস্ত দেবতায় অধিষ্ঠিত। গীতা, গঙ্গা, গায়ত্রী এবং গোবিন্দ এই চারিটি গকারপূর্ব পদার্থ যাঁহার হৃদয়ে বিদ্যমান, তাঁহার পুনর্জন্ম হয় না। গীতায় ছয় শত কুড়ি শ্লোকে ভগবান কৃষ্ণের উত্তর উক্তি, সাতান্ন শ্লোকে অর্জুনের প্রশ্ন প্রকটন, সাতষট্টি শ্লোকে সঞ্জয়ের সংসাব-বিবরণ এবং একটিমাত্র শ্লোকে ধৃতরাষ্ট্রের গীতোক্ত বিষয়ে উপষ্টম্ভ সঙ্কলিত আছে। মহাভারতের সারসর্বস্ব গীতারূপ অমৃত উদ্ধৃত করিয়া কৃষ্ণ অর্জুনের মুখে অর্পন করিয়াছেন।
ভগবদগীতাপর্বাধ্যায় সমাপ্ত।

No comments:

Post a Comment