বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথিকেই অক্ষয় তৃতীয়া বলা হয় । হিন্দু শাস্ত্রানুসারে অক্ষয় তৃতীয়া অনন্য তাৎপর্যময় এবং পরম মাহাত্ম্যপূর্ণ তিথি। অক্ষয় শব্দের অর্থ হলো যার ক্ষয় নেই ; তাই এই মহাপবিত্র তিথিতে কোন শুভকার্য সম্পাদন করলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে।
অক্ষয় তৃতীয়া সম্পর্কে শ্রীচৈতন্যের সমসাময়িক স্মার্তচূড়ামণি শ্রীরঘুনন্দন ভট্টাচার্য প্রণীত "তিথিতত্ত্বম্" গ্রন্থে যা বলা আছে তাই সংক্ষেপে সংস্কৃত শ্লোক থেকে বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তুলে ধরছি :
#স্মৃতিতে বলা আছে - বৈশাখ মাসের শুক্লতৃতীয়া যদি কৃত্তিকা বা রোহিণীনক্ষত্র যুক্ত হয়, তবে তাকে অক্ষয় তৃতীয়া বলে। এ দিনে দান সহ যে যে পবিত্র কর্ম করা হয় তার সকল ফলই অক্ষয় হয়।
#ভবিষ্যোত্তর পুরাণে বলা আছে - বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের যে তৃতীয়া তিথি, তা জগতে অক্ষয় নামে প্রসিদ্ধ, তাই দেবগণেরও প্রিয় এ তিথি। যে মনুষ্য এ দিনে জল ও অন্ন-সম্মিলিত কুম্ভ দান করে সে জ্যোতির্ময় সূর্যলোক প্রাপ্ত হয়।
#ব্রহ্মপুরাণে বলা আছে - বৈশাখমাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়াতে যে ব্যক্তি চন্দনচর্চিত ভগবান শ্রীহরি বিগ্রহ দর্শন করে, সে ভগবানের পরমধামে গমন করে।
আরও বলা আছে - শ্রীভগবান বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়াতে সত্যযুগের অবতারণা করেন এবং খাদ্যশস্য হিসেবে যবের উৎপত্তি করেন। তাই এ দিনে যব দ্বারা ভগবানের পূজা করবে এবং ব্রাহ্মণ সহ সকলকে যব দান করবে এবং ভোজন করাবে। এদিনে পতিতপাবনী গঙ্গাও পৃথিবীতে অবতরণ করে। তাই এ দিনে মহাদেব, গঙ্গা,কৈলাস ও হিমালয় পর্বতাদির পূজা করবে এবং সাথে সাথে সগরকুলের ধুরন্ধর ভগীরথ রাজারও পূজা করবে। এ দিনে স্নান,দান, তপ,শ্রাদ্ধ এবং হোম ইত্যাদি যে যে মঙ্গলময় অনুষ্ঠান করবে, তা সকলই অক্ষয় ফল দান করবে।
#স্কন্ধপুরাণে ভগবান বলছেন- বৈশাখমাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া অক্ষয়া নামে অভিহিত, সেই তৃতীয়াতে আমার শরীর শোভন ও সুগন্ধ লেপনদ্রব্য দ্বারা লিপ্ত করবে।
রঘুনন্দনের বলা ছাড়াও আরো অসংখ্য মাহাত্ম্যপূর্ণ এবং তাৎপর্যময় ঘটনার তিথি পবিত্র এ অক্ষয় তৃতীয়া :
#ভগবানশ্রীপরশুরাম অবতাররূপে আসেন এ দিনেই।
#শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়নবেদব্যাস এ দিনেই মহাভারতের রচনা শুরু করেন।
#দশমহাবিদ্যার অন্যতম দেবী ধুমাবতীর আবির্ভাব এ দিনেই।
#সত্যযুগের শুরু এ দিন থেকেই।
#ভারতের_উত্তরাঞ্চলীয় চারধামের অন্যতম কেদার বদরীনাথের মন্দির ছয়মাস বন্ধ থেকে এ দিনেই তার দ্বার খুলে দেয়া হয়। দ্বার খুললেই অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ দৈব অক্ষয়দীপের দর্শন হয় সকলের।
#কুবেরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান মহাদেব তাঁকে অতুল ঐশ্বর্য প্রদান করেন এদিনেই। কুবেরের লক্ষ্মী এবং অতুল ঐশ্বর্য লাভ হয়েছিলো বলে এদিনে তাই বৈভব-লক্ষ্মীর পূজা করা হয়।
#পুরীধামে_জগন্নাথদেবের_রথযাত্রা উপলক্ষে রথ নির্মাণ এ দিন থেকেই শুরু হয় এবং আজ থেকেই থেকেই জগন্নাথদেবের ২১ দিনব্যাপী চন্দনযাত্রা উৎসবের সূচনা ঘটে।
#সকল_দেবস্থানে বিশেষ করে বৈষ্ণবদেবস্থানে এ দিন থেকেই মহাধুমধামে চন্দনযাত্রা উদযাপিত হয়।
#সাধকপুরুষ_রামচন্দ্রদেবের এ দিনে তিরোধান দিবস। তাই এ দিনে সারাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ নোয়াখালীর চৌমুহনীতে স্থিত তাঁর সমাধিবেদিতে জল দান করেন।
তাই এদিনে আমরা যদি ভালো কাজ করি, তবে আমাদের অক্ষয় পূণ্য লাভ হবে পক্ষান্তরে তামসিক খারাপ কাজের ফল হবে অক্ষয় পাপের যমযন্ত্রণা । তাই এদিন খুব সাবধানে প্রতিটি কাজ করা উচিত। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে ভুলেও যেন কোনো পাপকাজ আমাদের দ্বারা না হয়ে যায়। এ দিনে ভুলেও যেন মন্দ-কটু কথা না বেরোয় আমাদের মুখ থেকে। তাই এদিন যথাসম্ভব সাত্ত্বিকভাব থাকা প্রয়োজন। আর এদিন পূজা,জপ,ধ্যান,দান,অপরের মনে আনন্দ দেয়ার মত কাজ করা উচিত। এদিনটা ভালোভাবে কাটানোর অর্থ সাধনজগতের পথে অনেকটা অনেকটা এগিয়ে ঈশ্বরের নৈকট্যলাভ । তাই পবিত্র অক্ষয়তৃতীয়ায় শ্রীভগবানের অপার করুণা আমাদের সবার পরমসঙ্গী হোক, এ শুভকামনা রেখে আমার এই লেখাটি শেষ করলাম।
শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।।
পোস্ট #২
আজ “অক্ষয় তৃতীয়া” । “অক্ষয়” শব্দের অর্থ যার ক্ষয় নেই । এমন বলা হয় এইদিন আপনি যা দান করবেন তার অক্ষয় ফল প্রাপ্ত করবেন । যে সকল পুণ্য কর্ম করবেন তা অক্ষয় হয়ে থাকবে । চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী এই দিন অনেক দোকানে “হালখাতা” করা হয় মঙ্গলমূর্তি গণেশের পূজা করে । এই তিথিতে বেশ কয়েকটি শুভ অনুষ্ঠান জড়িত । আজ গঙ্গা দেবী মর্তে এসেছিলেন। সগর রাজার বংশ কপিল শাপে ভস্ম হলে- তাঁদের প্রেতাত্মার মুক্তির জন্য রাজা সগর এর বংশ পরম্পরায় তপস্যা চলে। ভগীরথের তপস্যায় প্রজাপতি ব্রহ্মা , গঙ্গা কে মর্তে আসবার অনুমতি দিলে একজন ধারকের প্রয়োজন হয়- কারন সরাসরি গঙ্গা দেবী বসুমতীতে অবতরণ করলে বসুমতী সেই বেগ সহ্য করতে অসমর্থা । ভগবান শিব সেই ধারক হন। পতিতপাবনী জাহ্নবী গঙ্গার স্পর্শে সেই প্রেতাত্মাগণের মুক্তি ঘটে । সেই পুন্যসলিলা মা গঙ্গার একবিন্দু পবিত্রজলেতে মহাপাপ নাশ হয় । দশমহাবিদ্যা দের মধ্যে মহাবিদ্যা মা ধূমাবতীর আবির্ভাব এইদিনেই হয় । দেবী এই বেশে সম্পূর্ণ আলাদা । তিনি বার্ধক্যে জর্জরিতা , সাদা থান পরিহিতা , কাকধ্বজ রথাসীনা , ঝাঁটা ও শূর্পধারিনী । দেবী স্বামীহীণা অর্থাৎ তিনি ভৈরবহীনা । এই ধূমাবতী দেবীর আবির্ভাব আজকের দিনে । ক্ষত্রিয় কূলের লাগামছাড়া অত্যাচারে ভগবান বিষ্ণু আজকের দিনে ভৃগু বংশে অবতার গ্রহণ করেন । মহর্ষি জমদাগ্নি মুনির পত্নী রেনুকাদেবীর গর্ভে তিনি আবির্ভূত হন। তাঁর নাম হয় রাম । ভগবান শিবের তপস্যা করে ইনি “পরশু” বা কুঠার প্রাপ্ত করেন- এবং তা ধারন করেন । সেই থেকে তাঁর নাম হয় পরশুরাম । ইনি দুষ্ট ক্ষত্রিয় দের ধ্বংস করেন । আজকের দিনে হস্তিনাপুরে কৌরবেরা শঠতা ও চালাকী অবলম্বন করে পাণ্ডবদের সাথে পাশা খেলে – পাণ্ডবদের পরাজিত করে সমস্ত কিছু নিয়ে নেয়। এমনকি যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীকে সভামাঝে নিয়ে এসে বিবস্ত্র করার চেষ্টা করে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় দ্রৌপদীর মান সম্মান অক্ষত থাকে । আজকের দিনে দ্রৌপদী সূর্য দেবতার থেকে অক্ষয় পাত্র প্রাপ্ত করেন । এই পাত্রে যা চাওয়া যেতো- সে তাই আহার প্রদান করতো । যতক্ষণ না দ্রৌপদী আহার করতো- ততক্ষণ এই পাত্র আহার দিতো। দ্রৌপদীর আহার হয়ে গেলে সেদিনের মতো এই পাত্র আর কিছু দিতো না। দুর্যোধন চালাকী দ্বারা মহর্ষি দুর্বাসা কে দ্রৌপদীর কাছে শিষ্য সমেত আহারের জন্য প্রেরন করেন । সেদিন দ্রৌপদীর আহার হয়ে গেলে মহর্ষি দুর্বাসা তার পাঁচ হাজার শিষ্য সমেত আসেন । পাণ্ডব গণ মহাচিন্তায় পড়লেন । কারন দুর্বাসা মুনি ক্ষিপ্ত হলে তাঁর অভিশাপে ভয়ানক কিছু একটা হতে পারে। তাই তাঁরা বিপদভঞ্জন মধূসুদন কে স্মরণ করলেন । শ্রীকৃষ্ণ এসে সব শুনে দেখলেন সেই অক্ষয় পাত্রে বিন্দুমাত্র শাকান্ন অবশিষ্ট আছে । ভগবান তাই সেবা নিলেন । সাথে সাথে সমগ্র জীবের উদর তৃপ্ত হোলো। দুর্বাসা মুনি ও তাঁর শিষ্যদের মনে হোলো তারা আকণ্ঠ খেয়েছেন, চলার শক্তি নেই, উদর খাদ্যে পূর্ণ । পরদিন পাণ্ডবেরা মহর্ষি দুর্বাসা ও তাঁর শিষ্যদের আদর যত্ন আপ্যায়ন করে ভোজোন করালেন । এছাড়া আজকের দিনেই গণপতি গনেশ বেদব্যাসের মুখনিঃসৃত কথা শুনে মহাভারত রচনা শুরু করেন। এদিনই দেবী অন্নপূর্ণার আবির্ভাব ঘটে। এদিনই সত্যযুগ শেষ হয়ে ত্রেতাযুগের সূচনা হয়।এদিনই কুবেরের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে অতুল ঐশ্বর্য প্রদান করেন। এদিনই কুবেরের লক্ষ্মী লাভ হয়েছিল বলে এদিন বৈভব-লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। এদিনই ভক্তরাজ সুদামা শ্রী কৃষ্ণের সাথে দ্বারকায় গিয়ে দেখা করেন এবং তাঁর থেকে সামান্য চালভাজা নিয়ে শ্রী কৃষ্ণ তাঁর সকল দুঃখ মোচন করেন। এদিন থেকেই পুরীধামে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষ্যে রথ নির্মাণ শুরু হয়। কেদার বদরী গঙ্গোত্রী যমুনত্রীর যে মন্দির ছয়মাস বন্ধ থাকে এইদিনেই তার দ্বার উদঘাটন হয়। দ্বার খুললেই দেখা যায় সেই অক্ষয়দীপ যা ছয়মাস আগে জ্বালিয়ে আসা হয়েছিল। এই হোলো অক্ষয় তৃতীয়ার কিছু প্রধান ঘটনা । এছারা লৌকিক, পৌরাণিক অনেক ঘটনা এই তিথির সাথে জড়িত ।
পোস্ট #৩
অক্ষয় তৃতীয়া কি এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ---
অক্ষয় তৃতীয়া হল চান্দ্র বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষের তৃতীয়া তিথি। অক্ষয় তৃতীয়া বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ তিথি। অক্ষয় শব্দের অর্থ হল যা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। বৈদিক বিশ্বাসানুসারে এই পবিত্র তিথিতে কোন শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে। যদি ভালো কাজ করা হয় তার জন্যে আমাদের লাভ হয় অক্ষয় পূণ্য আর যদি খারাপ কাজ করা হয় তবে লাভ হয় অক্ষয় পাপ। আর এদিন পূজা, জপ, ধ্যান, দান, অপরের মনে আনন্দ দেয়ার মত কাজ করা উচিত। যেহেতু এই তৃতীয়ার সব কাজ অক্ষয় থাকে তাই প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হয় সতর্কভাবে। এদিনটা ভালোভাবে কাটানোর অর্থ সাধনজগতের অনেকটা পথ একদিনে চলে ফেলা। এবারের অক্ষয়তৃতীয়া সবার ভালো কাটুক-এই কামনায় করি।এদিন যেসকল তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল।
১) এদিনই বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম জন্ম নেন পৃথিবীতে।
২) এদিনই রাজা ভগীরথ গঙ্গা দেবীকে মর্ত্যে নিয়ে এসেছিলেন।
৩) এদিনই গণপতি গনেশ বেদব্যাসের মুখনিঃসৃত বাণী শুনে মহাভারত রচনা শুরু করেন।
৪) এদিনই দেবী অন্নপূর্ণার আবির্ভাব ঘটে।
৫) এদিনই সত্যযুগ শেষ হয়ে ত্রেতাযুগের সূচনা হয়।
৬) এদিনই কুবেরের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে অতুল ঐশ্বর্য প্রদান করেন।
এদিনই কুবেরের লক্ষ্মী লাভ হয়েছিল বলে এদিন বৈভব-লক্ষ্মীর পূজা করা হয়।
৭) এদিনই ভক্তরাজ সুদামা শ্রী কৃষ্ণের সাথে দ্বারকায় গিয়ে দেখা করেন এবং তাঁর থেকে সামান্য চালভাজা নিয়ে শ্রী কৃষ্ণ তাঁর সকল দুখ্হ মোচন করেন।
৮) এদিনই দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে যান এবং সখী কৃষ্ণাকে রক্ষা করেন শ্রীকৃষ্ণ। শরনাগতের পরিত্রাতা রূপে এদিন শ্রী কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে রক্ষা করেন।
৯) এদিন থেকেই পুরীধামে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষ্যে রথ নির্মাণ শুরু হয়।
১০) কেদার বদরী গঙ্গোত্রী যমুনত্রীর যে মন্দির ছয়মাস বন্ধ থাকে এইদিনেই তার দ্বার উদঘাটন হয়। দ্বার খুললেই দেখা যায় সেই অক্ষয়দীপ যা ছয়মাস আগে জ্বালিয়ে আসা হয়েছিল।
১১) এদিনই সত্যযুগের শেষ হয়ে প্রতি কল্পে ত্রেতা যুগ শুরু হয়।
No comments:
Post a Comment