Hare Krishna

Hare Krishna
Welcome to ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ

Thursday, May 4, 2017

ব্রহ্মচর্য এবং উপনয়ন কি নারীদের জন্যও প্রযোজ্য ? নারীদের কি বেদপাঠে অধিকার আছে ?

বর্ণবাদী হিন্দু ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বেদপাঠ ও উপনয়নে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার স্বীকার করতে চান না। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ও নারীকে অবদমিত করে রাখার কুপ্রবৃত্তিই এর মূল কারন, আর এর সঙ্গে অজ্ঞানতা তো আছেই! আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের সমাজে আজও কিছু মানুষ এই প্রশ্ন তোলেন। আশা করি আজকের আলোচনার পর এবিষয়ে আর কোন প্রশ্ন এবং দ্বিধা প্রকাশের অবকাশ থাকবে না।
প্রাচীন বৈদিক সমাজে নারীশিক্ষার ও নারীদের উপনয়ন তথা ব্রহ্মচর্য জীবন পালনের একটি চিত্র দেখা যাক:
“ব্রহ্মচর্যেন কন্যা যুবানং বিন্দতে পতিম্।”
(অথর্ববেদ ১১.৫.১৮)
অর্থাত্ ঠিক যেমন যুবক ব্রহ্মচর্য শেষ করে বিদুষী কন্যাকে বিয়ে করবে ঠিক তেমনি একজন যুবতীও ব্রহ্মচর্য শেষ করে পছন্দমত বিদ্বান যুবককে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবে।
পাণিনি তার সংস্কৃত ব্যকরন শাস্ত্রে ছাত্রীদের ব্রহ্মচর্যের প্রতিষ্ঠান ছাত্রীশালা ও এর মহিলা অধ্যাপক আচার্যনি এর এর উল্লেখ করেছেন-
“মাতুলাচার্যাণামানুক্ত”
(পাণিনি ৪.১.৪৬)
এবং “ছাস্যাদযঃ ছাত্রীশালাযাম্”
(পাণিনি ৬.২.৭৬)
ব্রহ্মচারিনী ছাত্রীদের নারী শিক্ষক উপদেষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদ ১.৩.১১, ১০.১৫৬.২ প্রভৃতিতে।
“চেতন্তি সুমতিনাম যজ্ঞম দধে সরস্বতী”
(ঋগ্বেদ ১.৩.১১)
এখানে নারী শিক্ষিকাকে জ্ঞানদাত্রী ও প্রেরণদাত্রীরূপে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে।
পবিত্র বেদ ও শতপথ ব্রাহ্মণে আমরা দেখতে পাই যে কিভাবে গার্গী, মৈত্রেয়ী, অত্রেয়ী, বাক, অপালাসহ বিভিন্ন নারীরা ব্রহ্মচর্য পালনের মাধ্যমে ঋষি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন।
উত্তররামচরিতমানস এর ২.৩ এ পাওয়া যায় ঋষিনী অত্রেয়ী বলছেন,
“এই অঞ্চলে অগস্ত্যসহ অনেক বিখ্যাত মহর্ষি আছেন। আমি মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রম থেকে এখানে এসেছি তাঁদের কাছ থেকে বেদ অধ্যয়ন করতে।”
“ওঁ শুদ্ধ পুত যোসিত যজ্ঞিয়া ইমা ব্রাহ্মনম হস্তেষু প্রপ্রতক সদায়মি।
যত্কামা ইদমাভিসিন্চমি বো হামিন্দ্রো মরুত্বন্স দদাতু তন্বে।। ওঁ”
অর্থাৎ “আমার সকল কন্যাগণ পবিত্র, ধর্মনিষ্ঠ, সকল ধর্মানুষ্ঠান (যজ্ঞাদি) পালনে যোগ্য।তাঁরা সকলে পবিত্র বেদ মন্ত্র নিষ্ঠার সহিত পাঠ করবে। তাঁরা সকলে বিদ্বান গুরুর নিকট বিদ্যালাভ করবে। ঈশ্বর তাদের নৈবেদ্য গ্রহণ করবেন।”
বৈদিক শাস্ত্রে নারীদের উপনয়ন তথা ব্রহ্মচর্য পালনের বিষয়ে এর চেয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণ আর কী হতে পারে?
সনাতন বৈদিক ধর্ম এমন একটি ধর্ম যার প্রধান ধর্মগ্রন্থের প্রাপক ও প্রচারকদের মহামনীষীদের মধ্যে নারী ঋষিকাগণ ছিলেন, যা পৃথিবীর অন্য কোন রিলিজিয়ন (ধর্ম একটিই, সনাতন ধর্ম, বাকীগুলো মার্গ/religion) এর পক্ষে চিন্তা করাও অসম্ভব।
চলুন দেখে নেই পবিত্র বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি ও ব্রহ্মজিজ্ঞাসুর মধ্যে কিছু শ্রদ্ধেয় নারী ঋষির(ব্রহ্মবাদিনী) নাম-
১) ঘোষা (ঋষি কক্ষিবান এর কন্যা, ঋগ্বেদ দশম মন্ডলের ৩৯-৪১ নং সুক্তের দ্রষ্টা)
২) অপালা (ঋষি অত্রি এর কন্যা, ঋগ্বেদ ৮/৯১/১ এর ঋষি )
৩) ইন্দ্রানী (ইন্দ্রের পত্নী, ঋগ্বেদ ১০/১৪৫/১-৬ এর ঋষি)
৪) ভগম্ভ্রীনি (মহর্ষি অম্ভ্রন এর কন্যা, ঋগ্বেদের অষ্টম মন্ডলের ১২৫ নং সুক্তের দ্রষ্টা)
৫) বাক্ (ঋগ্বেদের বিখ্যাত দেবীসুক্তের দ্রষ্টা ঋষি) এছাড়াও রয়েছেন:
৬) রাত্রি (মহর্ষি ভরদ্বাজের কন্যা)
৭) বিশ্ববারা (ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলের অষ্টবিংশ সূক্তের ঋষি)
৮) রোমশা ৯) কত্রু ১০) গার্গেয়ী ১১) জুহু ১২) মৈত্রেয়্ ১৩) যরিতা ১৪) শ্রদ্ধা ১৫) উর্বশী ১৬) স্বর্ণগা ১৭) পৌলমী ১৮) সাবিত্রী ১৯) দেবায়নী ২০) নোধা ২১) আকৃষ্ভাষা ২২) শীকাতনবাবরি ২৩) গণ্পায়নী ২৪) মন্ধত্রী ২৫) গোধ ২৬) কক্ষিবতী ২৭) দক্ষিনা ২৮) অদিতি ২৯) অপত ৩০) শ্রীলক্ষ ৩১) লোপামুদ্রা প্রমুখ।
যে ধর্মের মুল ধর্মগ্রন্থ বেদের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি নারী হতে পারেন, সেই ধর্মে নারীর মর্যাদা, বেদপাঠের অধিকার, উপনয়ন ও ব্রহ্মচর্যের অধিকার নিয়ে আলোচনা করাটাই এক দুঃখজনক ব্যাপার।
এ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দের কিছু কথা খুব প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ:
“ …সাধারণের ভেতর আর মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার না হলে কিছু হবার জো নেই। সেজন্য আমার ইচ্ছা কতকগুলি ব্রহ্মচারী ও ব্রহ্মচারিণী তৈরি করব।
…ব্রহ্মচারিণীরা মেয়েদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করবে। কিন্তু দেশী ধরণে ঐ কাজ করতে হবে। পুরুষদের জন্য যেমন কতকগুলি শিক্ষাকেন্দ্র করতে হবে, মেয়েদের শিক্ষা দিতেও সেইরুপ কতকগুলি কেন্দ্র করতে হবে। শিক্ষিতা ও সচ্চরিত্রা ব্রহ্মচারিণীরা ঐ সকল কেন্দ্রে মেয়েদের শিক্ষার ভার নেবে। পুরান, ইতিহাস, গৃহকার্য, শিল্প, ঘরকন্নার নিয়ম ও আদর্শ চরিত্র গঠনের সহায়ক নীতিগুলি বর্তমান- বিজ্ঞানের সহায়তায় শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্রীদের ধর্মপরায়ন ও নীতিপরায়ণ করতে হবে। কালে যাতে তারা ভাল গিন্নি তৈরি হয়, তাই করতে হবে। এই সকল মেয়েদের সন্তানসন্ততিগণ পরে ঐ সকল বিষয়ে আরও উন্নতি লাভ করতে পারবে। যাদের মা শিক্ষিতা ও নীতিপরায়ণা হন, তাদের ঘরেই বড়লোক জন্মায়।
… মেয়েদের আগে তুলতে হবে, জনসাধারণকে জাগাতে হবে; তবে তো দেশের কল্যাণ।
ধর্ম, শিক্ষা, বিজ্ঞান, ঘরকন্না, রন্ধন, সেলাই, শরীরপালন এ-সব বিষয়ে স্থুল মর্মগুলোই মেয়েদের শেখানো উচিত।
…সব বিষয়ে চোখ ফুটিয়ে দিতে হবে। আদর্শ নারী চরিত্রগুলি ছাত্রীদের সামনে সর্বদা ধরে উচ্চ ত্যাগরূপ ব্রতে তাদের অনুরাগ জন্মে দিতে হবে। সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী, লীলাবতী, খনা, মীরা এদের জীবনচরিত্র মেয়েদের বুঝিয়ে দিয়ে তাদের নিজেদের জীবন ঐরূপে গঠন করতে হবে।
…বৈদিক যুগে, উপনিষদের যুগে দেখতে পাব- মৈত্রেয়ী গার্গী প্রভৃতি প্রাতঃস্মরণীয়া মেয়েরা ব্রহ্মবিচারে ঋষিস্থানীয়া হয়ে রয়েছেন। হাজার বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সভায় গার্গী সগর্বে যাজ্ঞবল্ককে ব্রহ্মবিচারে আহবান করেছিলেন।
…মেয়েদের পূজা করেই সব সব জাত বড় হয়েছে। যে দেশে, যে জাতে মেয়েদের পূজা নেই, সে দেশ সে জাত কখনও বড় হতে পারেনি, কস্নিন কালে পারবেও না। তোদের জাতের যে এত অধঃপতন ঘটেছে, তার প্রধান কারণ এইসব শক্তিমূর্তির অবমাননা করা। …যেখানে স্ত্রীলোকের আদর নেই, স্ত্রীলোকেরা নিরানন্দে অবস্থান করে, সে সংসারে- সে দেশের কখন উন্নতির আশা নেই (মনুসংহিতা বাণী); এজন্য এদের আগে তুলতে হবে- এদের জন্য আদর্শ মঠ স্থাপন করতে হবে।”
এই হলো স্বামীজির বিবেচনা। অথচ ভণ্ড পৌরানিক স্মৃতিকার পুরোহিতগণ পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে মনুস্মৃতিতে সংযোজন এনে একসময় নারীদের শাস্ত্রপাঠ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, নারীবিদ্বেষী শ্লোক সংযুক্ত করেন, সতীদাহের মত বেদবিরুদ্ধ একটা জঘণ্য প্রথা চালু করেছিলেন।
আসুন, মিথ্যা ও কুসংস্কার দুর করে, বেদের শুভ্র শ্রেষ্ঠ পথ অনুসরণ করে নারী-পুরুষ বৈষম্যহীন মানব সমাজ গঠন করি।
বেদের শাশ্বত সত্য পৌঁছে দিন সকলের মাঝে!
সৌজন্য -হিন্দু ধর্ম জিজ্ঞাসা।

No comments:

Post a Comment