জগতের দার্শনিকগণের মধ্যে শ্রীপাদ্ শঙ্করাচার্যের নাম অগ্রগণ্য। তাঁর জীবনী নিয়ে এ-পর্যন্ত সহস্রাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে অনেকগুলিই দিগ্বিজয় সম্পর্কিত। আচার্য উদয়বীর শাস্ত্রী রচিত বেদান্তদর্শনের সুবৃহৎ প্রথম ভাগটি আচার্য শঙ্করের আবির্ভাবের সময়কাল নির্ধারণেই সম্পূর্ণ হয়েছে। কামকোটি মঠ থেকে ইংরাজিতে 'Shankracharya an Appriser'(আচার্য শঙ্করের জীবনীর পূর্ণমূল্যাঙ্কন) নামে মুম্বাই থেকে আরও একটি বই প্রকাশিত হয়েছে এবং তাতে আচার্য শঙ্করের জীবনাবলীর অনেক রঙ্গিন চিত্রও রয়েছে। আচার্য শঙ্করের সংক্ষিপ্ত জীবনী নিম্নরূপ-
আচার্য শঙ্করের দিগ্বিজয় তথা 'গুরুবংশকাব্যম্' ও 'গুরুপরস্পরা চরিত্রম্' এবং তাঁর অন্যান্য জীবন-চরিত্রের যে সকল প্রমাণাদি পাওয়া যায় তা থেকে বোঝা যায় যে তিনি একজন অসাধারণ দিব্য প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর জীবনে অগাধ পাণ্ডিত্য, গম্ভীর বিচারশৈলী, অসাধারণ কর্মক্ষমতা, অসীম ভগবদ্ভক্তি, তীব্র বৈরাগ্য, অদ্ভুত যোগৈশ্বর্যাদি অনেক দুর্লভ গুণের সামঞ্জস্য দেখা যায়। তাঁর বাণীতে যেন সাক্ষাৎ সরস্বতি বিরাজিত ছিলেন। মাত্র ৩২ বছর বয়সেই তিনি অনেক সুবৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি সমগ্র ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করে ভিন্ন মতাবলম্বী অনেক পণ্ডিতকে শাস্ত্রার্থে পরাজিত করে দেশের চারকোণে চারটি প্রধান মঠ স্থাপন করে সমগ্র দেশে বৈদিক সনাতন ধর্মের ধ্বজা উত্তোলন করেছিলেন। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে ধরাধামে অবতরণ করে আচার্য শঙ্কর যেন নিমজ্জমান সনাতন ধর্মকে রক্ষা করেছিলেন এবং তারই ফলস্বরূপে আজ আমরা এই ধর্মকে বিকশিত অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। তাঁর ধর্মস্থাপনের কার্য ক্ষমতা দেখে এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয় যে তিনি সাক্ষাৎ শিবের অবতার ছিলেন- 'শংকরঃ শঙ্করঃ সাক্ষাৎ' এবং এজন্যই তাঁর নামের পূর্বে ভগবান শব্দ সংযোজন করে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করা হয়।
কেরল প্রদেশের পূর্ণা নদীর তটবর্তী কলাদী নামক গ্রামে বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথীতে আচার্য শঙ্কর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম শিবগুরু এবং মাতা হলেন সুভদ্রা। শিবগুরু অতিশয় বিদ্বান এবং খুবই ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ছিলেন। সুভদ্রাও পতির অনুরূপ বিদুষী এবং ধর্মপরায়ণা মহিলা ছিলেন। পৌঢ়াবস্থাতেও সন্তান না হওয়ায় স্বামী-স্ত্রী অত্যন্ত শ্রদ্ধা-ভক্তির সঙ্গে সন্তানের জন্য শিবের কঠিন তপঃপূর্ণ উপাসনা করেন। ভগবান আশুতোষ উপাসনায় প্রসন্ন হয়ে প্রকট হন এবং তাঁদের মনোবাঞ্ছিত বর প্রদান করেন। ভগবান শঙ্করের আশীর্বাদে শুভ মুহূর্তে মা সুভদ্রার এক দিব্য কান্তিমান পুত্ররত্নের প্রাপ্তি হয়। ভগবান শঙ্করের নামে সন্তানটির নামও রাখা হয় শঙ্কর।
বালক শঙ্করের রূপে যেন এক মহান বিভূতি অবতীর্ণ হয়েছে- বাল্যাবস্থাতেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। এক বছর বয়স পূর্ণ হতে না হতেই বালক শঙ্কর মাতৃভাষাতেই মনোভাব ব্যক্ত করতে লাগলেন এবং দু-বছর বয়স থেকেই মায়ের নিকট থেকে পুরাণাদি শ্রবণ করে কন্ঠস্থ করতে আরম্ভ করলেন। তিন বছর বয়সে তাঁর মুণ্ডন কার্য সমাধা করে বাবা পরলোকে গমন করলেন। পাঁচ বছর বয়সে উপবীত ধারণ করিয়ে তাঁকে গুরুগৃহে লেখাপড়া শেখানোর জন্য পাঠানো হয় এবং মাত্র আট বছর বয়সেই বেদ-বেদান্ত এবং বেদান্তের অধ্যয়ন সম্পূর্ণ করে তিনি বাড়ি ফিরে এলেন। তাঁর এরূপ অসাধারণ প্রতিভা দেখে গুরুজন বিস্ময়ে হতবাক হন।
বিদ্যা অধ্যয়ন সমাপন করে শঙ্কর সন্ন্যাস গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। মায়ের নিকট অনুমতি প্রার্থনা করায় তিনি রাজি হন নি। শঙ্কর খুবই মতৃভক্ত ছিলেন। মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণে ইচ্ছুক ছিলেন না। একদিন মায়ের সঙ্গে তিনি নদীতে স্নান করতে যান। সেখানে একটি কুমির শঙ্করকে ধরে ফেলে। এই অবস্থায় ছেলেকে দেখতে পেয়ে মায়ের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। তিনি আর্তনাদ করে ওঠেন। শঙ্কর মাকে বললেন যে যদি সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে কুমিরটি তাকে ছেড়ে দেবে। সঙ্গে সঙ্গেই মা অনুমতি দেন এবং কুমিরটিও শঙ্করকে ছেড়ে দেয়। সন্ন্যাস গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করার সময় মায়ের ইচ্ছামত শঙ্কর কথা দিয়ে যান যে তিনি মৃত্যুকালে মায়ের নিকট উপস্থিত থাকবেন।
গৃহত্যাগ করে শঙ্কর নর্মদা তটে উপস্থিত হলেন এবং সেখানে গোবিন্দভগবৎপাদের কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেন। দীক্ষান্তে গুরুদেব তাঁর নাম রাখেন 'ভগবৎপূজ্যপাদাচার্য'। গুরু নির্দিষ্ট পথে তিনি সাধন আরম্ভ করলেন এবং স্বল্পকালের মধ্যেই একজন বিশিষ্ট যোগসিদ্ধ মহাত্মা হলেন। তাঁর সিদ্ধিতে সুপ্রসন্ন হয়ে গুরুদেব তাঁকে কাশীতে গিয়ে বেদান্ত-সুত্রের ভাষ্য লেখার আদেশ দিলেন।
কাশীতে আগমনের পর তাঁর খ্যাতির বিস্তার হতে লাগল এবং তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনেকে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে লাগল। তাঁর সর্বপ্রথম শিষ্য হলেন সনন্দন। কালক্রমে তিনি 'পদ্মপাদাচার্য' নামে বিখ্যাত হন। কাশীতে শিষ্যদের পড়াবার সাথে-সাথে তিনি গ্রন্থও করতে থাকেন। শোনা যায় যে একদিন ভগবান শঙ্কর তাঁকে দর্শন দেন এবং ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য তথা ধর্মের প্রচার করার আদেশ দেন। বেদান্তসূত্রের ভাষ্য লেখা সমাপ্ত হলে একদিন গঙ্গাতটে জনৈক ব্রাহ্মণ তাঁকে এর একটি সূত্রের অর্থ জিজ্ঞাসা করেন। সেই সূত্রের অর্থ নিয়ে তাঁদের মধ্যে সাতাশদিন ধরে শাস্ত্রার্থ চলতে থাকে। পরে তিনি জানলেন যে স্বয়ং ভগবান বেদব্যাস ব্রাহ্মনবেশে প্রকট হয়ে তাঁর সঙ্গে শাস্ত্রার্থ করছেন। তখন তিনি তাঁকে ভক্তিভরে প্রণাম করে ক্ষমা চাইলেন। তখন ব্যাসদেব তাঁকে অদ্বৈতবাদের প্রচার করার আদেশ দিলেন এবং তাঁর আয়ু ১৬ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩২ বছর প্রদান করলেন। এরপর দিগ্বিজয় করতে বেরিয়ে পড়েন। কাশীতে থাকাকালীন আচার্য শঙ্কর সেখানে বসবাসকারী প্রায় সকল বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের শাস্ত্রার্থে পরাজিত করেছিলেন। পরে সেখান থেকে তিনি কুরুক্ষেত্র হয়ে বদ্রিকাশ্রমে গমন করেন। সেখানে কিছুকাল অবস্থান করে তিনি আরও একটি গ্রন্থ রচনার কাজ সম্পন্ন করেন। বদ্রিকাশ্রম থেকে পায়ে হেঁটে শঙ্কর প্রয়াগতীর্থে আগমন করেন এবং সেখানে কুমারিলভট্টের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। কুমারিলভট্টের কথানুসারে আচার্য শঙ্কর প্রয়াগ থেকে মাহিস্মতী(মহেশ্বর)নগরীতে মণ্ডন মিশ্রের সঙ্গে শাস্ত্রার্থের জন্য উপস্থিত হন। মণ্ডন মিশ্রের ঘরের দরজা বন্ধ থাকায় যোগবলে শঙ্কর ঘরের আঙ্গিনায় উপস্থিত হন এবং মণ্ডন মিশ্রকে শাস্ত্রার্থে আহ্বান করেন। শ্রাদ্ধের কাজ সম্পন্ন করে মণ্ডন মিশ্র শাস্ত্রার্থে বসেন এবং বিচারক হন মণ্ডন মিশ্রের বিদুষী পত্নী ভারতী। শাস্ত্রার্থে পরাজিত হয়ে মণ্ডন মিশ্র শঙ্করের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এই মণ্ডন মিশ্রই পরবর্তীকালে 'সুরেশ্বরাচার্য' নামে বিখ্যাত হন। প্রচলিত আছে যে, মণ্ডন মিশ্র পরাজিত হওয়ায় তাঁর বিদুষী পত্নী ভারতী শঙ্করাচার্যকে শাস্ত্রার্থে আহ্বান করেন এবং তাঁকে কাম-বিষয়ক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। তখন শঙ্করকে যোগবলে মৃত রাজা অমরুকের দেহে প্রবেশ করে কামশাস্ত্রের বিদ্যা অর্জন করতে হয়েছিল। স্বামী সন্নায়স গ্রহণ করলে পত্নী ভারতী ব্রহ্মলোকে প্রয়াণে উদ্যত হওয়ায় আচার্য শঙ্কর অনেকভাবে বুঝিয়ে তাঁকে নিরত করেন এবং শৃঙ্গগিরিতে নিয়ে আসেন। শঙ্করের অনুরোধে তিনি সেখানে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। শোনা যায় যে, ভারতীর কাছ থেকে শিক্ষিত হওয়ায় শৃঙ্গেরী এবং দ্বারকা পীঠের শিষ্য-সম্প্রদায় 'ভারতী' নামে খ্যাত হয়েছেন। সমগ্র মধ্যভারতে জয় হওয়ার পর শঙ্করাচার্য দক্ষিণ ভারতে গমন করেন এবং মহারাষ্ট্রে শৈব ও কাপালিকদের পরাজিত করেন। জৈনিক ধূর্ত কাপালিক শঙ্করাচার্যকে বলি দেওয়ার অভিপ্রায়ে ছলনা করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। সে যখন শঙ্করাচার্যকে বলি দিতে উদ্যত হয় তখন পদ্যপাদাচার্য তাকে নিহত করেন। সেই সময়ও শঙ্করাচার্যের সাধনার বিশেষ প্রভাব দেখা যায়। কাপালিকের তীক্ষ্ণ তরবারির মুখেও তাঁকে সমাধিস্থ ও শান্তচিত্তে উপবিষ্ট দেখা যায়। এরপর আরও দক্ষিণ অভিমুখে গিয়ে তিনি তুঙ্গভদ্রা নদীর তটে মঠ স্থাপন করে শারদাদেবীর মূর্তি স্থাপন করেন। এই মঠটিই কালক্রমে 'শৃঙ্গেরি মঠ' নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। 'সুরেশ্বরাচার্য' এই মঠের প্রথম আচার্য নিযুক্ত হন। এই সময় আচার্য শঙ্কর মায়ের মৃত্যু সন্নিকট জেনে গৃহে উপস্থিত হন এবং নিজের হাতে পায়ের অন্ত্যেষ্টি-ক্রিয়া সম্পন্ন করেন। শোনা যায় যে, মায়ের অভিপ্রায়ে অন্তিমকালে ঈশ্বরের সাক্ষাৎ দর্শন করিয়ে তিনি তাঁকে বিষ্ণূধামে প্রেরণ করেন। সেখান থাকে শৃঙ্গেরী মঠে ফিরে এসে পুরী আগমন করেন এবং তথায় গোবর্ধন পীঠের স্থাপনা করে পদ্যপাদাচার্যকে সেখানকার অধিপতি নিযুক্ত করেন। চোল এবং পাণ্ড্যরাজাদের সহায়তায় তিনি দক্ষিণাত্যের শাক্ত, গাণপত্য ও কাপালিকদের অনাচার-অত্যাচার দূর করেছিলেন। এরূপ দক্ষিণের সর্বত্র ধর্মের পতাকা উত্তোলন করে এবং বেদান্তের মহিমা ঘোষিত করে শঙ্করাচার্য পুনরায় উত্তরাভিমুখী হন। পথে কিছুদিন বরার নামক স্থানে কাটিয়ে তিনি উজ্জৈন আসেন এবং সেখানকার ভয়ঙ্কর ভৈরব-সাধনার ইতি সাধন করেন। সেখান থেকে গুজরাতে এসে দ্বারকায় একটি মঠ স্থাপনা করে হস্তমলকাচার্যকে সেখানকার আচার্যের পদে নিযুক্ত করেন। এরপর গাঙ্গেয় প্রদেশের পণ্ডিতদের পরাস্ত করে কাশ্মিরের শারদাক্ষেত্রে প্রবেশ করেন এবং সেখানকার পণ্ডিতদের পরাজিত করে নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। সেখান থেকে তিনি আসামের কামরূপে আগমন করে শৈবদের সঙ্গে শাস্ত্রার্থ করেছিলেন। সেখান থেকে তিনি পুনরায় বদ্রিকাশ্রমে ফিরে এসে জ্যোতিমঠের স্থাপনা করে তোটকাচার্যকে সেখানকার মঠাধীস নিযুক্ত করেন। সেখান থেকে তিনি কেদারক্ষেত্রে আসেন এবং কিছুদিন পরে দেবলোকে প্রয়াণ করেন।
Monday, May 1, 2017
শ্রীপাদ্ শঙ্করাচার্য হিন্দু ধর্মের পথপ্রদর্শক
Hey visitor! I'm Satyajit Roy holding a big name of famous indian film director! but not for nothing at all ��. Trying to write something about something.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment