Hare Krishna

Hare Krishna
Welcome to ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ

Sunday, June 25, 2017

রথযাত্রার ইতিহাস

রথযাত্রার তথ্য উদঘাটন করতে অনেক দূর যেতে হবে। রামায়ণ ও মহাভারতে রথের জলন্ত প্রমাণ পাওয়া যাবে। বিশাল রথে চড়ে রাম ও রাবণের যুদ্ধ, মেঘের আড়ালে মেঘনাথ রথে চড়ে যুদ্ধ করতেন। লঙ্কার যুদ্ধে রাবণ স্ববংশে তার সৈন্যসহ নিহত হলে রাম সীতা ও লক্ষণসহ পুষ্পক রথে চড়ে অযোধ্যায় ফিরে ছিলেন।
মহাভারতে গান্ধর্বরাজ শ্রী চিত্রসেন সদলবলে রথে চড়ে মহাকাশে বেড়িয়ে বেড়াতেন। মর্ত্যের কদিন আগে থেকে রথ চালু হয়েছে তার অনুসন্ধান চলছে। তবে আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধ নেপালের তরাই অঞ্চলে কাপিল বস্ত নগরে রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কঠোর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। বুদ্ধগয়ারা তারপর তিনি একটা নতুন ধর্ম মত প্রচার করেন। তাই বৌদ্ধ ধর্ম। কালক্রমে নেপালসহ ভারত বর্ষে এবং দেড়শত বছরের মধ্যে প্রায় সমগ্র এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। গৌতম বুদ্ধের শেষ জীবনে নেপালে রথযাত্রা প্রচলন হয়। ইতোমধ্যে চারশ বছর কেটে গেছে। তারপরে ভারতবর্ষের নানা স্থানে রথযাত্রা পত্তন ঘটে। তখন ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের জোয়ারে হিন্দু ধর্ম কমে যায়। তার ছয়শ বছর পর হিন্দু ধর্মের উপর বৌদ্ধ ধর্মের চরম অত্যাচার শুরু হয়।
সেই ক্লান্তিলগ্নে কেরালার একস্থানে ভগবান শঙ্কাচার্য নামক এক বিরাট ধর্মবতা জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাত্র ৩৬ বছর জীবিত ছিলেন।
পনের বছর বয়স থেকেই তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। তিনি ভারতবর্ষের চারিপ্রান্তে চারটি মট স্থাপন করে তার কাজ শুরু করেন। তার অল্প কিছুদিন আগেই বৌদ্ধধর্ম মহাযান ও হীনযান এ দুই মতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। হীনযানগণই সংখ্যায় ছিল অধিক। তারা আবার হিন্দুধর্মে ফিরে আসে। হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানে উপমহাদেশ থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলোপ হয়। রথযাত্রার প্রধান উৎসব হয় উড়িষ্যার (উৎকল) পুরীতে। সেখানে আছে জগন্নাথ (জগতের নাথ) দেবের মন্দির। এ মন্দির পৃথিবী বিখ্যাত। জগন্নাতরা ভাই বোন তিনজন একই মন্দিরে পূজিত হন। এখানকার রথ পৃথিবী বিখ্যাত। প্রতিবছর তিনজনের জন্য তিনটি নতুন রথ তৈরি হয়। সেই রথগুলো মাঘ মাসের শুল্কা পঞ্চমীর দিন থেকে তৈরি করা শুরু হয়। প্রথম রথে চড়ে জগন্নাথ মাসির বাড়ি যান এবং তার উচ্চতা ৪৫ হাত। দ্বিতীয়টি উচ্চতায় একটু কম তাতে বলরাম এবং শেষেরটায় আরেকটু ছোট তাতে বোন শুভভ্রা যান। ৮ দিনের জন্য তারা মাসির বাড়িতে থাকেন। তারপর আবার নিজ নিজ রথে মন্দিরে ফিরে আসেন।
শ্রীকৃষ্ণের দ্বাপর যুগে লীলা সম্ভরণের পরবর্তীতে রথে থাকেন
জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা যা খর্বাকৃতি। ভক্তবৃন্দ ভক্তি সহকারে রথরজ্জুর মাধ্যমে রথকে টেনে এগিয়ে নিয়ে যান। শাস্ত্রে আছে 'রথস্থ বাম নং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।' রথের উপরে খর্বাকৃতি বামন জগন্নাথকে দর্শন করলে তার পুনর্জন্ম হয় না। তাই রথরজ্জু ধরে
রথটানা মহাপুণ্য কর্ম বলে সনাতন ধর্মে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ দিন সম্পর্কে পৌরানিক ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ওড়িশার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে। সে সময় আজকের ওড়িশার নাম ছিল মালবদেশ। সেই মালবদেশের অবন্তীনগরী রাজ্যে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন, যিনি ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। পরবর্তিকালে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন করেন।
ইন্দ্রদ্যুম্ন লীলা অবতার শ্রী কৃষ্ণ তার ভাই বলরাম ও বোন সুভদ্রার ত্রিমূর্তি কল্পনায় বিভোর হয়ে পড়লেন। কৃষ্ণ সান্নিধ্য লাভের আশায় রাজকার্যাদি ভুলে গিয়ে তিনি পাগল প্রায়। শয়নে স্বপনে শুধু কৃষ্ণ দর্শন পেতে লাগলেন তিনি। অবশেষে একদিন এ ত্রিমূর্তি নির্মাণের পরিকল্পনা করলেন রাজা। ভগবান নারায়ন স্বয়ং বিশ্বকর্মা রূপধরে রাজার
সামনে আসলেন। ছদ্মবেশী ভগবান কারিগর মূর্তি তিনটি তৈরির জন্য ২২ দিন সময় প্রার্থনা করলেন রাজার কাছে। এবং শর্ত আরোপ করলেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মূর্তি
নির্মাণাধীন কক্ষের দরজা খোলা যাবে না। একে একে ১৪ দিন পার হল। বাইরে অপেক্ষমান রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন মূর্তি তিনটি দেখার জন্য আকুল হয়ে উঠলেন। বিশ্বকর্মার কাজের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে তিনি মূর্তি নির্মাণাধীন কক্ষের দরজা খুলে ফেললেন। দরজা খোলা মাত্র দেখতে পেলেন জগন্নাথ, বলদেব ও শুভদ্রা দেবীর অসম্পূর্ণ মূর্তি।
কারিগর বিশ্বকর্মার কোন দেখা নেই। এমতাবস্থায় রাজা শর্তের কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এবং অতি দুঃখে ঠিক করলেন প্রাণ বিসর্জন দেবেন। রাজা প্রস্তুত প্রাণ বিসর্জন দেবেন এমন সময় দৈব বাণী হল,“ হে ভক্তবর তুমি প্রাণ বিসর্জন দিওনা। আমি এ রূপেই তোমার সেবা গ্রহণ করবো”। সে সময় পুলকিত রাজা অসম্পূর্ণ মূর্তি নিয়ে নগর পরিক্রমা করেন এবং পূজা প্রচলন করেন। সেই থেকে বাহ্যিক রূপ কে নয় অন্তনির্হিত শক্তিকে মূল্যায়ন করার জন্য ভক্তিভরে পালিত হয় জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা। কেননা রথে অধিষ্ঠিত অসম্পূন্ন জগন্নাথ দেব হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান শ্রী কৃষ্ণ, বলদেব হচ্ছেন বলরাম এবং শুভদ্রা দেবী তাদের ভগ্নি।
রথযাত্রা উৎসব হচ্ছে বড় ভাই বলরাম বা বলভদ্র ও বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন যাত্রার স্মারক। তিন জনের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রথ। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় হল এই রথ তিনটি। প্রথমে যাত্রা শুরু করে বড় ভাই বলভদ্রের রথ। এই রথের নাম তালধ্বজ। রথটির চোদ্দোটি চাকা। উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। রথের আবরণের রঙ নীল। তারপর যাত্রা করে সুভদ্রার রথ। রথের নাম দর্পদলন। উচ্চতা প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। এই রথের মোট বারোটি চাকা। যেহেতু রথটির ধ্বজা বা পতাকায় পদ্মচিহ্ন আঁকা
রয়েছে তাই রথটিকে পদ্মধ্বজও বলা হয়ে থাকে। রথের আবরণের রঙ লাল। সবশেষে থাকে জগন্নাথদেবের রথ। রথটির নাম নন্দীঘোষ। পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি আঁকা রয়েছে তাই এই রথের আর একটি নাম কপিধ্বজ। রথটির উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। এতে ষোলোটি চাকা আছে। প্রতিটি চাকার ব্যাস সাত ফুট। রথটির আবরণের রঙ
হলুদ। তিনটি রথের আবরণীর রঙ আলাদা হলেও প্রতিটি রথের উপরিভাগের রঙ
লাল।
রথের সূচনায় উড়িষ্যা থেকে প্রায় উত্তর ভারতে আষাঢ় মাসে, গুজরাটে কার্তিক মাসে এবং দাক্ষিণাত্যে মাঘ মাসে রথ হতো। কালক্রমে হিন্দুদের পুনরুত্থানে ধর্মীয় নেতারা একত্রিত হয়ে ঠিক করেন আষাঢ় মাসে শুল্কা দ্বিতীয়াতে সবস্থানেই রথ হবে। কারণ হিসেবে বোঝা সম্ভব যে আষাঢ় মাস থেকেই সম্পদের সময় হয়। অর্থাৎ শীতকালে যে আমন ওঠে তার উৎস আষাঢ় মাসে।
রথযাত্রা একটা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। কারণ রথের দিন থেকে পূজার বছর শুরু হয়। রথের দিন থেকে আগামী এক বছরে যতো পূজা হবে তার দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়। যে বছর আষাঢ় মাসের শেষের দিকে হবে সেই বছর সব পূজা বিলম্বে হবে। রথে তিনটি তল থাকে। এ তিনটি তল ত্রিকালকে নির্দেশ করে। তৃতীয় তলের ওপর গম্বুজ থাকে। গম্বুজের মধ্যে ঠাকুর থাকেন। আষাঢ় মাসের শুল্কা দ্বিতীয়ায় ঝিরে ঝিরে বৃষ্টির মধ্যে যখন রথ চলতে থাকে তখনই উচ্চস্বরে কীর্তনের দল গাইতে থাকে 'রাধার মদন-মোহন দয়া কর হে গৌবিন্দ গোপীনাথ'। রথের সেই দৃশ্য ভক্তগণের কাছে এক অপরূপ দৃশ্য উপহার দেয়। রথের দড়ি টানার জন্য ভক্তরা উদগ্রীব। দড়ি টানলে হৃদয় রথ শক্তিশালী হবে। যারা দড়ি টানতে অক্ষম তারা রশিটাকে একবার স্পর্শ করে তৃপ্তি লাভ করে।
বিশ্বের অনেক দেশে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব সাড়ম্বরে পালন করা হয়।

No comments:

Post a Comment