Hare Krishna

Hare Krishna
Welcome to ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ

Monday, March 27, 2017

আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের প্রতিষ্ঠাতা - আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ (৩ এপ্রিল ১৯৭২ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরের খ্রীষ্টান চার্চে প্রদত্ত শ্রীমদ্ভাগবত প্রবচন থেকে সংকলিত)

গ্রহ-নক্ষত্র সবই ভগবানের সৃষ্টি। ভগবান আছেন। মানুষ যেমন তার শক্তি প্রয়োগে এই মেলবোর্ন শহরটিকে গড়ে তুলেছে, তেমনই এই সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড পরম পুরুষোত্তম ভগবানের শক্তিরই প্রকাশ। এ কথা আপনারা অগ্রাহ্য করতেই পারেন না। একেই বলা হয় জ্ঞান, যে-জ্ঞানের দ্বারা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ উপলব্ধি করা যায়, বোঝা যায় তাঁর শক্তিসমূহ কোন্গুলি, কিভাবেই-বা সেইগুলি সক্রিয় হয়ে উঠছে, কাজ করছে, কেমন করে এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের মাঝে এই সমস্ত বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটে চলেছে। একেই বলা হয় কৃষ্ণভাবনামৃত।
কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার আন্দোলন কোনও ধাপ্পাবাজি নয়। অতি বিজ্ঞানসঙ্গত এই আন্দোলনটি। মানব জাতির যথার্থ জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই আন্দোলন সনাতন ভাবধারার উন্মোচন করছে। জ্ঞানের পরিধি বিশাল বিরাট। কিন্তু আমরা যদি কেবলমাত্র নিজেদের শরীরের প্রয়োজন মেটাতেই আগ্রহী হয়ে থাকি পশুদের মতো, তবে আমরা যথার্থ জ্ঞান আহরণের সুযোগ হারাব।
আহার-নিদ্রা-ভয় মৈথুনম্ চ সামান্যমেতৎ পশুভির্নরাণাম্।।
এই যে খাওয়া, ঘুম, যৌনসঙ্গম আর নিজেকে বাঁচানোর তাগিদ, এই সবই তো পশুজীবনের ব্যাপার। একটা শূয়োরও দিন-রাত খেটে চলেছে- ‘কোথায় মল, কোথায় মল’ খুঁজতে খুঁজতে। ঐ পশুটি মল বিষ্ঠা চায়। ঐসব সে খায় আর খুব মোটা হয়।  ওটাই সে উপভোগ করে।
অতএব, এই যে আহার, নিদ্রা, আত্মরক্ষা এবং মৈথুন ক্রিয়ার তীব্র প্রবণতা, এইগুলি পশুজীবন এবং মনুষ্য-জীবন দুটি ক্ষেত্রেই সাধারণভাবে স্বাভাবিক। কিন্তু মানব জীবনের একটা বিশেষ মর্যাদালব্ধ অধিকার আছে। তা হল কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলন, ভগবানকে জানবার আগ্রহ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান আহরণের প্রবৃত্তি। কেবলমাত্র পশুদের মতো নয়।  আমরা অবশ্য মানুষ হয়েও কেবলমাত্র এমন সমস্ত বিষয়ে জ্ঞানের বিকাশ সাধন করতে চাইছি, যার মাধমে শিখছি কিভাবে খেতে হয়, কিভাবে ঘুমাতে হয়, কিভাবে যৌন ক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয় এবং কিভাবে নিজেকে বাঁচাতে হয়। সেইগুলিরও প্রয়োজন অবশ্য আছে। দেহ যতদিন রয়েছে, ততদিন আমরা বলতেই পারি না যে, এই সব নিয়ে কোন চেষ্টার দরকার নেই।
কিন্তু মানুষ হিসেবে আমাদের যে বিশেষ জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজন, তা হল আত্মজ্ঞান- নিজেকে জানবার বিশেষ আগ্রহ এবং ভগবানকে জানার আকুলতা। সেই ব্যাপারটা আপনারা কেন বরবাদ করে রেখেছেন?  ওটা তো ভাল কথা নয়।
এই সমস্ত শাস্ত্র…….এই সমস্ত শাস্ত্র থেকে, জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থাদি থেকে আমি যে কত রকমের উদ্ধৃতি তুলে শোনাচ্ছি- এইগুলি মানবজাতির জন্য শোনাচ্ছি, কুকুর-বেড়ালদের জন্য নয়। এই সে সভাটি আমরা আহ্বান করেছি, এখানে আমরা তো কুকুর আর বেড়ালদের আমন্ত্রণ জানাইনি, আমরা মানুষদের নিমন্ত্রণ করে এনেছি, কারণ মানুষই এই সব কথা বুঝতে পারে। বেড়াল আর কুকুরদের সামনে আমি যতই বৈদিক শাস্ত্র থেকে পড়ে শোনাই, কিংবা ভগবদ্গীতা বা ভাগবত থেকে ভাল ভাল কথা শোনাই, বেড়াল আর কুকুরদের পক্ষে তা বোঝা মোটেই সম্ভব নয়।  তাদের শরীরটা ভিন্ন ধরনের। কিন্তু আমাদের শরীর, মানব-শরীর, এই উদ্দেশ্যেই বিশেষ ধরনের সৃষ্টি হয়েছে।
ঋষভদেবের পুত্র ছিলেন ভরত মহারাজ, যাঁর নামে ভারতবর্ষের নাম হয়েছে- পুরাকালে এই সমগ্র পৃথিবী গ্রহটারই নাম ছিল ভারতবর্ষ। বৈদিক শাস্ত্রে ভারতবর্ষ বললেই এই গ্রহটিকে বোঝায়। এতে সাতটি দ্বীপ রয়েছে-সেই বর্ণনাও ভাগবত গ্রন্থে পাই। সেই সপ্ত দ্বীপ মানে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং ওসিয়ানিয়া।  এই সপ্ত দ্বীপের কথা বৈদিক শাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে।
তাই এই গ্রহ, এটি ভারতবর্ষ নামে পরিচিত ছিল। এখন নানাভাবে বিভক্ত হয়েছে। এখন প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতি লুপ্ত হওয়ার জন্যই আমরা বহু বিভক্ত হয়ে গিয়েছি। আমি ভাবছি, “আমি ভারতের লোক”, আপনারা ভাবছেন, “আমরা অস্ট্রেলিয়ার লোক”, অন্যেরা ভাবছেন, তাঁরা আমেরিকার বাসিন্দা কিংবা ব্রিটেনের অধিবাসী। এই জাতিবিভাগ হয়েছে পরে, এই ধরা যাক, তিন হাজার কি চার হাজার বছর হবে। তার আগে এই গ্রহটি ছিল একটি অখণ্ড সাম্রাজ্য, অখণ্ড জনগণ। তখন ছিলেন একজন মাত্র রাজা। বৈদিক শাস্ত্রসম্ভার থেকে আমরা এই তথ্য পেয়েছি। সেই রাজা তখনকার দিনে সমগ্র পৃথিবী শাসন করতেন। সংস্কৃতি ছিল অভিন্ন- তার নাম "বৈদিক সংস্কৃতি"। এখনও আমি শুনতে পাই আমার কোনও কোনও শিষ্য বলে, অস্ট্রেলিয়াতে কিছু কিছু হিন্দু মন্দির আজও বিদ্যমান রয়েছে। এসব কথা বাদ দিলেও, একটা ব্যাপার বুঝতে হবে যে, মানব সমাজের মূল ভাবধারা আমরা আবার পুনরুজ্জীবিত করে তোলার চেষ্টা করে চলেছি। এই ভাবধারাটি হল কৃষ্ণভাবনামৃত।
এই যে সব তরুণ ভক্তরা, বেশির ভাগই ইউরোপবাসী, আমেরিকাবাসী, কানাডাবাসী- এরা কেউ ভারতীয় নয়, তাদের বাপ-ঠাকুরদা কেউই শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। হয়ত তাঁদের কেউ কেউ ভগবদ্গীতা পড়ে থাকতে পারেন, কিন্তু বিশেষভাবে কিছুই জানতেন না, শ্রীকৃষ্ণ সম্পর্কিত চিন্ময় তত্ত্ব তাঁদের জানাই ছিল না। এখন তাঁরা কৃষ্ণভাবনামৃত আস্বাদন করছেন এবং হরেকৃষ্ণ আন্দোলনে সম্পূর্ণ গুরুত্ব সহকারে আত্মনিয়োগ করেছেন- কেমন ভাবে?
একমাত্র ব্যাপার হল এই যে, কৃষ্ণভাবনামৃত কারও কাছেই ভিন্দেশের কথা নয়। আপনাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কৃষ্ণভাবনা রয়েছে। সেটা সুপ্ত হয়ে আছে।  শুধু সেটিকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে হবে। কেবল জাগিয়ে তুলতে হবে।
এক প্রামাণ্য বৈষ্ণব কবি বলেছেন-
নিত্যসিদ্ধ কৃষ্ণপ্রেম সাধ্য কভু নয়।
শ্রবণাদি শুদ্ধ চিত্তে করয়ে উদয়॥
‘উদয়’ মানে জাগিয়ে তোলা। কৃষ্ণভাবনা অন্তরের মাঝে রয়েছে। প্রত্যেকের অন্তঃস্তলে তা সুপ্ত হয়ে আছে। শুধুমাত্র ‘শ্রবণাদি’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা জেগে উঠবে। ঠিক যেমন, কোনও মানুষ ঘুমাচ্ছে, তার চেতনা তো রয়েছেই, কিন্তু মনে হচ্ছে অচেতনভাবে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু কেউ যদি তাকে ডাকে, ‘ওঠ ওঠ।’ দু-তিনবার ডাকলেই সে উঠে পড়ে।  তখন সে ভাবতে থাকে, ‘ওঃ আমাকে কত কাজ করতে হবে।’
তেমনি, কৃষ্ণভাবনা সকলের হৃদয়ে প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। এই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র দিয়ে সেই আচ্ছন্ন ভাব কাটিয়ে তোলার পন্থা আয়ত্ত করা চাই। ব্যস্, তা হলেই হল।
এই যে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র আমরা বারে বারে জপ করছি-
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে ॥
এই জপের ধ্বনি শ্রবণ করতে থাকলেই মানুষ জেগে উঠবে কৃষ্ণভাবনামৃত আস্বাদনের আগ্রহ নিয়ে। এই হল পন্থা।
এই কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচার আন্দোলনের ভাবধারা অতীব সহজ সরল। এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে কেউ কিছুই হারায় না। ধরুন, আপনার বাড়িতে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করেন।  আপনার কি মনে হয় তাতে আপনার কোনও ক্ষতি হয়? না। তার জন্য আমরা আপনাদের কাছ থেকে কোনও পয়সা চাই না, মন্ত্র শেখানোর জন্য কোন রকম দক্ষিণা নিই না। ওরকম কোনও ব্যাপার নেই। সব ব্যাপারটা খোলামেলা, উদার মুক্ত। যে কেউ জপ করতে পারেন। তবে জপ করলে আপনারই লাভ। চেতোদর্পণ মার্জনম্ । আপনার চিত্ত-দর্পণটি মার্জিত হতে থাকবে।
একেবারে নিখরচায়।
এখন আমাদের মনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের চেতনা সক্রিয় হয়ে রয়েছে-‘‘আমি অমুক, আমি তমুক।’’ আর সেই জন্যই সারা পৃথিবীতে এত ঝঞ্ঝাট, কারণ এই শরীরটার ভুল পরিচয় আমরা শিখেছি- যে শরীরটি নিতান্তই জামা-কাপড়েরই মতো পোশাকের আচ্ছাদন মাত্র।
মনে করা যাক, আমরা এখানে বসে আছি, কয়েকজন ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা রয়েছেন- এখানে যদি আমরা আমাদের পোশাক নিয়ে বিবাদ শুরু করে দিই- ‘‘আপনি ঐ  ধরনের পোশাক পরেছেন, আমি এই রকম পোশাক পরেছি। তা হলে আপনি নিশ্চয়ই আমার শত্রু।’’ এটা তো মোটেই ভাল যুক্তি হল না।  আমি আপনাদের মতো পোশাক পরিনি বলেই আপনাদের শত্রু তো আমি নই। আর আপনারাও অন্য ধরনের পোশাক পরে আছেন বলে আমার শত্রু তো নন। কিন্তু এই ব্যাপারটাই চলেছে। ‘‘আমি আমেরিকান’’, ‘‘আমি ভারতীয়’’, ‘‘আমি চীনা’’, আমি রাশিয়ান’’, ‘‘আমি এই’’, ‘‘আমি সেই’’। আর লড়াই চলেছে শুধুমাত্র এই নিয়েই।
তাই বলছি, আপনারা যদি কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করেন, তা হলে এই ভন্ডামি দূর হয়ে যাবে। ঠিক যেমন দেখছেন আমাদের এই সমস্ত শিষ্যদের।  ওরা কেউ চিন্তা করে না ভারতীয় কিংবা আমেরিকান কিংবা আফ্রিকান কিংবা অন্য কিছু বলে। ওরা কেবলমাত্র চিন্তা করতে শিখেছে, ‘‘আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দাস মাত্র।’’ সেটাই চাই।
সেটারই প্রয়োজন।
আমরা যদি এই উপলব্ধির স্তরে আসতে পারি, ‘চেতোদর্পণ মার্জনম্’…..‘অহং ব্রহ্মাস্মি’- ‘আমি শুদ্ধ আত্মা, চিন্ময় আত্মা। এই দেহটি, এই জড় শরীরটি আমার আচ্ছাদন মাত্র। তা হলেই যথার্থ জ্ঞান অর্জিত হয়েছে বলতে পারা যায়।
আর আপনারা যে মুহূর্তে এই উপলব্ধির পর্যায়ে আসতে পারবেন, এই জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হবেন। তখনই আসবে বৈরাগ্য। বৈরাগ্য মানে নিরাসক্তি। ঠিক এই সব ভক্ত তরুণ শিষ্যদের মতো। এরা আমেরিকান। অতি উচ্চ জীবন ধারায় তাদের মা-বাবা ওদের পালন করেছেন। আজ তারা যে কোনও জায়গায় বসতে পারে বিনা দ্বিধায়।  তারা পথের ধারে বসে পড়তেও পারে, কারণ জীবের দেহাত্মবুদ্ধি তারা ভুলে গেছে। তারা এখন সব কিছু চিন্তা করে কৃষ্ণভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে- ‘‘আমি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দাস মাত্র।’’
সুতরাং, এই আন্দোলনটি অত্যন্ত সমাজবিজ্ঞান সম্মত আন্দোলন- চেতোদর্পণ মার্জনম্- অন্তর পরিচ্ছন্ন করুন- ‘‘কে আমি? কে ভগবান? ভগবানের সাথে আমার কি সম্পর্ক? কেন আমি দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছি? কেন আমি জন্ম নিয়েছি? কেন আমাকে মৃত্যুবরণ করতেই হবে? কেন আমাকে ব্যাধিগ্রস্ত হতেই হবে? কেন আমাকে জরাগ্রস্ত হতেই হবে?’’ এই সমস্ত সমস্যা নিয়ে চিন্তা এবং তার সমাধান নিয়ে আলোচনাই এই আন্দোলনের লক্ষ্য।
এই সমস্ত সমস্যা মানব জীবনেই সমাধান করা সম্ভব- কুকুর-বেড়ালের জীবনে সম্ভব নয়। ওরা এভাবে চিন্তা করতে পারে না। তাই আমাদের অনুরোধ- আপনাদের জীবনটাকে সার্থক করে তুলুন। আপনার অস্তিত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে এগিয়ে আসুন। আর সেটা সম্ভব খুবই সহজে কেবলমাত্র হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপের মাধ্যমে-
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

No comments:

Post a Comment