“ত্যক্ত্বা, সুদুস্ত্যজ-সুরেপ্সিত-রাজ্যলক্ষ্মীং,
ধর্ম্মিষ্ঠ আর্য্যবচসা যদ্গাদরন্যম।
মায়ামৃগং দয়িতয়েপ্সিতমন্বধাবদ্
বন্দে মহাপুরুষ তে চরণারবিন্দম্”।।
ভা- ১১/৫/৩৪
[রামচন্দ্র লীলাপর অর্থঃ- আপনি মানব ধর্ম্ম্ আচরণ চতুর রামাবতারে পিতার আদেশে সুরগণেরও বাঞ্ছনীয়, সুতারাং অপরের দুস্ত্যজ্য রাজ্য-সম্পদ পরিত্যাগ করিয়া বনে গিয়াছিলেন এবং পতিপ্রাণা পত্নী সীতার অভীপ্সিত মায়ামৃগের পশ্চাদ্ধাবন করেছিলেন, হে মহাপুরুষ আমি আপনার পাদপদ্ম বন্দনা করি।]
শ্রীবিশ্ববৈষ্ণব-রাজসভার পাত্র-রাজ শ্রীব্রাহ্ম-মধ্ব-শ্রীরূপানুগ-গৌড়ীয় সম্প্রদায়ৈক সংরক্ষক শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যান্বায়-নবমাধস্ত
নান্বয়বর আচার্য্যবর্য্য জগদ্ গুরু ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংস ১০৮ শ্রীশ্রীমদ্ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর বলেন ‘রাম’ তিনজন।
(১) জানকীরমণ রাম।
(২) রেবতীরমণ রাম।
(৩) রাধিকারমণ রাম।
তন্মধ্যে জানকীরমণ রাম পরতত্ত্ব ভগবানের পরাবস্থ স্বরূপত্রয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। যথা-
নৃসিংহ-রাম কৃষ্ণেষু ষাড়্গুন্যং পরিপূরিতম্।
পরাবস্থাস্ত্ত তে তস্য দীপাদুৎপন্নদীপবৎ।।
লঘুভাগবতামৃত-৫/১৬ (পদ্মপুরাণ ধৃত শ্লোক)
অর্থাৎ ‘নৃসিংহ’, ‘রাম’ ও ‘কৃষ্ণে’ পরিপূর্ণরূপে ষড়গুণ বিদ্যমান। যেমন প্রদীপ হইতে প্রদীপান্তরের উৎপত্তি হইলেও সকল প্রদীপই সমান ধর্মাবলম্বী। তদ্রূপ স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হইতে রাম ও নৃসিংহের আবির্ভাব হইলেও এই তিনজনই ষড়গুণের পরাবস্থাপন্ন। অতএব শাস্ত্রে সম্পূর্ণাবস্থাকে পরাবস্থা বলিয়া নির্ধারণ করিয়াছেন।
এই পরাবস্থা-স্বরূপস্থ দ্বিতীয় রাম রাঘবেন্দ্র (রাম), দাশরথি (রাম) নামেও জগতে বিদিত আছেন। শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৩/২২) উক্ত আছে- “ভগবান দেবকার্য্য সাধনার্থ রামরূপে নরদেবত্ব (রাজদেহ) প্রকটন করিয়া সমুদ্রবন্ধনাদিরূপ অসাধারণ প্রভাব দেখাইয়াছিলেন। যথা-
নরদেবত্বমাপন্ন সুরকার্য্যচিকীর্ষয়া,
সমুদ্রনিগ্রহাদীনি চক্রে বীর্য্যান্যতঃ পরম্।
---রাঘবেন্দ্র নবদূর্বাদলকান্তি ধারণপূর্বক ভরত, লক্ষ্মণ ও শত্রুঘ্নের সহিত বৈবস্বত মন্বন্তরীয় চতুর্বিংশ চতুর্যুগের ত্রেতাযুগেতে দশরথ হইতে কৌশল্যার গর্ভে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। স্কন্ধপুরাণে রামগীতায় বলিয়াছেন-
শ্রীরাম-বাসুদেব, লক্ষ্মণ-সঙ্কর্ষণ, ভরত- প্রদ্যুম্ন এবং শত্রুঘ্ন-অনিরুদ্ধরূপ চতুর্ব্যূহ। শ্রীমদ্ভাগত অনুসারে রাম অষ্টাদশতম অবতার। আর দশাবতারের গণনায় তিনি সপ্তম। তাঁহার বসতিস্থল মধ্যদেশস্থিত অযোধ্যাপুরী এবং মহাবৈকুন্ঠলোক।
ভগবান রামচন্দ্র কালের অধীন নন- তাঁহা হইতে কাল নির্গত হইয়াছে। সুতারাং শ্রীরামচন্দ্রের পার্ষদগণও কালের অধীন নহেন। তাঁহারা নিত্য স্ব-স্বরূপে বিরাজিত বলিয়া অমর। দেবতাগণের অমরত্ব আপেক্ষিক। দেবতাগণের ভূমিকা ও ভগবৎ পার্ষদগণের ভূমিকা এক নহে। মনোধর্মের বিচারে চিজ্জড় সমন্বয় অভ্যাস-আবর্ত্ত উপস্থিত হয়। এই মনোনিগ্রহের নামই সাধন। “সর্ব্বে মনোনিগ্রহলক্ষণান্তাঃ”। আমরা কর্মের দ্বারা বাহ্য শরীরমাত্র লাভ করি। কর্মফল ভোগার্থ নানা যোনিতে ভ্রমণ করি। বাসনা চরিতার্থ করবার জন্য। কেহ কেহ বলেন, বাসনা বিনাশের জন্য ‘তপস্যা’ ও ‘ভক্তি’ যাজন করিব। কিন্তু তপস্যা-অভক্তি, ভক্তির সহিত তাহার মিশ্রণ নাই। আরোহবাদ মূলে যে নাস্তিকতা, তাহা হইতেই তপস্যার পিপাসা। রাবণ, হিরণ্যকশিপু, দন্তবক্র, বিরোচন প্রভৃতি ভগবদ্ বিদ্বেষী অসুরগণেরও ‘তপস্যা’ দেখতে পাওয়া যায়। তপস্যার স্পৃহা পরিত্যাগ না করা পর্য্যন্ত ভক্তির আরম্ভ হয় না। ভক্তির দ্বারাই সাধন ও সিদ্ধি সম্পূর্ণ হয়। ভক্তি নিরপেক্ষা ও পরম সবলা। ভক্তির সহিত ‘ব্রত’, ‘তপস্যা’, ‘কর্ম’, ‘জ্ঞান’, ‘যোগ’ ইত্যাদি কোনপ্রকার অন্যাভিলাষ মিশ্রিত করিয়া ভক্তিকে সবলা করিবার দুর্বুদ্ধি ও তদ্দ্বারা আত্মাকে প্রসন্ন করিবার চেষ্টাও দুর্বুদ্ধিতা।
চরিত্রালোচনা
শ্রীরামচন্দ্র চিন্ময় শোকারতি হইতে জাত চিন্ময় করুণরস বিদ্যমান। তাঁহার লীলায় শিক্ষা ও ভক্তির তারতম্য বিচার এই যে, কৈকেয়ী মন্থরার কুমন্ত্রণায় রামের বনবাস ও ভরতের রাজ্যাভিষেক – এই দুই বর দশরথের নিকট প্রার্থনা করেন। দশরথ বাৎসল্যরসে চতুর্বূহ্যের সেবক। কৈকেয়ী অংশ-ভগবান ভরতের- চতুর্বূহ্যান্তর্গত প্রদ্যুম্ন ভগবানের বাৎসল্যরসের সেবিকা। দশরথ যে সেবাফলের অধিকারী, কৈকেয়ীর প্রার্থনায় তিনি সেই সেবাসুখ হইতে বঞ্চিত হইলেন। কৈকেয়ী অংশ-ভগবান নিজ পুত্রের পূর্ণতা বিধান করিতে গিয়া পূর্ণ ভগবান রামের সেবা হইতে বঞ্চিতা হইলেন,- আত্মসুখ-কামনানিরতা হইলেন (মন্থরার সঙ্গ ও পরামর্শহেতু )। পূর্ণ ভগবানের সেবা হইতে বিচ্যুতা হওয়াতে রামকে নির্বাসিত করিবার বুদ্ধি তাঁহাতে উদিত হইল এবং প্রদ্যুম্ন ভগাবনের সেবা হইতেও বিচ্যুতা হইলেন। ইহাতে শিক্ষা এই যে, “পূর্ণ ভগবদ্বস্তুর সেবায় অনাদরে অংশ ভগবদ্বস্তুর সেবা হইতেও বিচ্যুতি ঘটে। এইরূপ হতভাগ্যের দুঃসঙ্গ ফলে চতুর্বূহ্যের সেবাসুখ হইতেও বঞ্চিত হইতে হয়। তাই শাস্ত্রবিচার হইল-
“ততো দুঃসঙ্গমুৎসৃজ্য সৎসু সজ্জেত বুদ্ধিমান্।
সন্ত এবাস্য ছিন্দন্তি মনোব্যাসঙ্গ মুক্তিভিঃ।।
ভা- ১১/২৬/২৬
এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, “শ্রীকৃষ্ণ স্বরাট সর্বতন্ত্র-স্বতন্ত্র লীলাময় পুরুষোত্তম। কিন্তু ভগবান শ্রীরামচন্দ্র নিজকে সর্বসুনীতি ও কর্তব্য পরায়ণতার শাসনাধীন করিয়া, বিনীতভাবে কৈকেয়ীর নিকট পিতার প্রতিশ্রুতির বিষয় শ্রবণ করিয়া, অবিচলিত চিত্তে গৃহত্যাগের আদেশ গ্রহণ করিয়াছিলেন। এখানে শিক্ষা হইল, “শ্রীরামচন্দ্র সর্ব-সৎকর্মশীলতা বিচারের আদর্শ ভগবদ্ অবতার। তিনি জাগতিক বিচার সম্পন্ন জনগণকে পাপকার্য্য হইতে উদ্ধারের আদর্শ প্রদর্শনকারী ভগবদ্ বিগ্রহ।
শ্রীভগবানের বাৎসল্যরসে সেবাকে মায়ার জগতের পুত্রস্নেহের ন্যায় কোন ব্যাপার বলিয়া যাহারা ভুল বিচার করে, তাহাদের সেই ভ্রম দূর করিবার জন্য সুনীতি পরায়ণ ভগবদ্ বিগ্রহ শ্রীরাম সীতাদেবী ও লক্ষ্মণের সহিত কিছুকালের জন্য অযোধ্যাবাসীর সঙ্গ ত্যাগ করিয়া মাতা-পিতাকেও ত্যাগ করিয়া বনগমন করেন।
কৈকেয়ীর নিকট প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ভয়ে দশরথ রামচন্দ্রকে নির্বাসিত করিতে বাধ্য হইলেন, কিন্তু পুত্র বিরহ সহ্য করিতে না পারিয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। পূর্ণ ভগবান শ্রীরামের সেবা-বিমুখ কৈকেয়ীর দুঃসঙ্গ ফলে দশরথের অপ্রকটের অভিনয়।
দশরথ ও বসুদেব উভয়েই বাৎসল্যরসে ভগবানের সেবক। কিন্তু উভয়ের সেবা আদর্শের মধ্যে তারতম্য আছে। ভগবৎ সেবা অপেক্ষা লোক প্রতিষ্ঠার্থ কর্তব্যপালন কার্য্য শ্রেষ্ঠ- এইরূপ বিচার সম্পন্ন নিম্নাধিকারীর আদর্শ দশরথের সেবা-আচরণে লক্ষিত হয়। অর্থাৎ ভগবৎ সেবা অপেক্ষা জগতের তাৎকালিক মঙ্গলবিধানের শ্রেষ্ঠতা যাঁহাদের বিচারে উদ্দিষ্ট, সেই সকল সৎকর্মী, সুনীতি পরায়ণ অথচ ভগবৎ সেবা বিমুখ, বঞ্চিত জনগণের জন্য দশরথের এই লীলার অভিনয়। এই স্থলে নিত্যপুত্র ভগবানের সেবাবৃত্তির ওজন জড়ভোগ-নীতিমূলে লঘু হইয়া পড়ে। পক্ষান্তরে বসুদেব, পুত্র কৃষ্ণের সুখ-বৃদ্ধি ও নির্বিঘ্নতার জন্য বিরোধীজন পরিবেষ্টিত কংস-কারাগার হইতে পলায়ন পূর্বক লৌকিক নীতিসমূহ উল্লঙ্ঘন করিতে বিন্দুমাত্রও দ্বিধাবোধ করেন নাই। সকল জাগতিক বিধি ও নীতি উল্লঙ্ঘন করিয়াও কৃষ্ণসেবা চেষ্টার আদর্শ বসুদেবের কারাগার হইতে কৃষ্ণকে ব্রজে প্রেরণ ব্যাপারে লক্ষিত হয়। সুতারাং রামলীলা অপেক্ষা কৃষ্ণলীলায় বাৎসল্যরসের উজ্জ্বলতা অধিক। বিধিবাধ্য নীতি পরায়ণ শ্রীরামের সেবা অপেক্ষা স্ব-তন্ত্র স্বেচ্ছাময় শ্রীকৃষ্ণের সেবা উন্নততর ও উজ্জ্বলতর। বিধিমার্গে শ্রীরামের সেবা এবং প্রীতিমার্গে শ্রীকৃষ্ণের সেবা- উভয়ের মধ্যে এই তারতম্য সুস্পষ্ট।
ভরত অংশ-ভগবান অর্থাৎ পরতত্ত্বের অংশ এবং পূর্ণভগবান বা পরতত্ত্বের পার্ষদ-সেবক। তাই তিনি নিজ নিত্য প্রভু- শ্রীরামচন্দ্রের নিত্যভৃত্য সূত্রে তাঁহারই অভিলাষ পূরণের জন্য প্রতিনিধিরূপে রাজ্য শাসন পূর্বক শ্রীরামের সেবাকার্য্যে প্রবৃত্ত। এই রাজ্যভার গ্রহণে ভরতের নিজের ইন্দ্রিয়তর্পণ বাঞ্ছা নাই। শ্রীরামের পাদুকাই তাঁহার নিত্যারাধ্য-এই সমুন্নত বিচার প্রদর্শন পূর্বক তিনি রাম সেবায় নিযুক্ত। এইরূপ কার্য্যে ভরতের যে প্রভুত্ব দৃষ্ট হইতেছে, উহা অভক্তের সেবা-বিমুখতা প্রদর্শন নহে। শ্রীভরত ভগবৎ সেবার উদ্দেশ্যে একান্তরূপে আত্মসুখ বাঞ্ছা পরিত্যাগের আদর্শ।
শূর্পণখার বিচার এই যে, শূর্পণখা ও তাঁহার সমশ্রেনীস্থ ভোগপরায়ণগণ ভগবৎ লক্ষ্মী সীতাদেবীর সুখদর্শনে ঈর্ষান্বিত হইয়া সেব্য ভগবানকে নিজের ভোগের বস্তুরূপে পাওয়ার চেষ্টা করে, অথচ সেবা করিতে চাহে না। কিন্তু সেব্য ভগবান কখনও ভোগের বস্তু হন না। তাই শূর্পণখার আশা ও চেষ্টা বিফল হইয়া গেল। নৈতিক জীবনের আদর্শ প্রদর্শনকারী একপত্নীব্রতধর শ্রীরামের নিকট ব্যর্থ মনোরথ হইয়া শূর্পণখা নিত্য আদর্শ ভগবৎ সেবক শ্রীলক্ষ্মণের নিকট হইতে আত্মেন্দ্রিয় তর্পণের চেষ্টায় প্রভুত্ব বা ভোগ করিতে গিয়া ভগবৎ সেবকের হস্তে সমুচিত দণ্ড লাভ করে। নীতি উল্লঙ্ঘনের চেষ্টায় তাঁহার অঙ্গবিকৃতি ঘটল। ইহাতে শিক্ষা এই যে, শ্রীভগবান নিত্য সেব্য বস্তু- তিনি কাহারও ভোগের বস্তু হন না। ভোগ বুদ্ধিতে ভগবানের ও ভক্তের সমীপবর্তী হইলে, সে ব্যক্তিকে ভক্তের হস্তে নিগৃহীত হইয়া বিকলাঙ্গ হইতে হয়।
মায়ামৃগ বিষয়টিতেও একটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষা বিদ্যমান। মায়ামৃগের জন্য সীতাদেবীর সনির্বন্ধ প্রার্থনা। ফলে সীতা রাবণ কর্তৃক অপহৃতা ও শ্রীরামের সঙ্গ হইতে বিচ্যুতা। সীতাদেবীর এইরূপ প্রার্থনায় জগতের নির্বোধ সাধারণ লোক সীতাদেবীকে সামান্য স্ত্রীলোকমাত্র ধারণা করিয়া থাকে। বস্তুতঃ নিজ জড় সুখকামী স্থুল বিচার পরায়ণ নির্বোধগণের দুর্লোভের প্রকার প্রদর্শনের নিমিত্ত সীতাদেবী ঐরূপ নিজসুখ প্রার্থনার অভিনয় করিলেন। জড় সুখভোগে আসক্ত লোক নিজের সুখ-সুবিধার জন্যই ভগবানের সেবা করিয়া থাকে। তখন ভোগবুদ্ধি বা মায়া কপট বেশে উপস্থিত হইয়া ঐরূপ কপট সেবক বা সেবকাভিমানীকে ভগবান হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া বহুদূরে অনভীষ্ঠের মধ্যে পাতিত করে। সীতাদেবী বস্তুতঃ ঐরূপ ভোগ বিচার পরায়ণা নহেন। তথাপি তিনি ভোগাকাঙ্খী স্তাবকগণের কার্য্যের অভিনয় করিয়া ইহা প্রদর্শন করাইতেছেন যে, শক্তি ও শক্তিমৎ তত্ত্ব আত্মগোপন করিবার উদ্দেশ্যে বহির্মুখ ব্যক্তিগণের চক্ষু আবৃত করিবার জন্য ঐরূপ লীলা করিয়া থাকেন। ইহাতে এই শিক্ষা বিজ্ঞাপিত হইল যে, ভোগবুদ্ধিতে ভগবৎ সেবা করিতে গেলে ভগবান হইতে দূরে অনিষ্টের মধ্যেই অবস্থান ঘটে। আত্মগোপন ও বিমুখ বঞ্চনের নিমিত্তই ভগবান ও ভগবচ্ছক্তির বিমুখমোহন-লীলা।
রাবণ কপট সন্ন্যাসীর বেশে দুর্বুদ্ধির বশে সীতাদেবীর নিকট ভিক্ষা প্রার্থনা করিতেছিল। প্রভূত জড় শক্তিশালী যথেচ্ছাচারী রাবণ জড় বুদ্ধির বিচারে নিজেকে শক্তিমৎ-তত্ত্বজ্ঞান করিয়া সাক্ষাৎ ভগবল্লক্ষ্মী সীতাদেবীকেও ভোগ করিবার জন্য লুব্ধ হইয়া, ঐরূপ কপটতা করিতেছিল। অকপট ভগবৎ ভক্তের ঐরূপ চিত্তবৃত্তি থাকে না। বহির্মুখ ভোগীকুল ভগবদ্-ভোগ্য বস্তুকেও নিজের ভোগ্য করিতে উদ্যত হয়।
সীতাহরণ বিষয়ে বিজ্ঞাপ্য এই যে, ছদ্মবেশী রাবণ সীতাহরণ করিতেছে। প্রকৃতপক্ষে রাবণ অপ্রাকৃত ভগবচ্ছক্তি সীতাদেবীকে স্পর্শমাত্র করিতেও পারে নাই। সীতাদেবীর এক মায়ামূর্ত্তিকে মাত্র অপহরণ করিয়াছিল। মায়িকবুদ্ধি রাবণের অপ্রাকৃত সেবাবুদ্ধি না থাকায় মায়াসীতা মাত্র হরণের ও বঞ্চিত হওয়ার যোগ্যতামাত্র তাঁহার আছে। তাই এখানে শিক্ষার বিষয়বস্তু হইল, অপ্রাকৃত ও সেব্য ভগবদ্বস্তুকে প্রাকৃত ও ভোগ্য বিচার করিয়া ইন্দ্রিয়ের দ্বারা পরিমাপ করিবার প্রয়াসী ব্যক্তি রাবণের মত বঞ্চিত হইয়া অশেষ দুর্গতি মাত্র আবাহন করে।
শ্রীরামচন্দ্রে সাধারণ ব্যক্তির ন্যায় সীতার অন্বেষণের জন্য চেষ্টা দেখিয়া, সাধারণ লোক রাম-সীতাকে মায়াবদ্ধ সাধারণ সংসারী স্ত্রী-পুরুষ মাত্র মনে করিয়া বঞ্চিত হইতেছে। কারণঃ তাঁহারা ভগবদ্ বিমুখতা বশতঃ শ্রীরাম-সীতাকে শক্তি-শক্তিমৎ বস্তু বলিয়া বুঝিতে পারিতেছে না। শ্রীভগবান ও তচ্ছক্তির কখনও বিচ্ছেদ নাই। অতএব শ্রীরামের সীতান্বেষণ ব্যাপারে বিমুখ-বঞ্চন-লীলা আছে। সুতারাং শিক্ষণীয় বিষয় এই যে, অপ্রাকৃত ভগবৎ স্বরূপে অবিশ্বাস বশতঃ ভগবল্লীলায় প্রকৃত তাৎপর্য্য বস্তুতঃ বোধগম্য হয় না। যাহারা পরতত্ত্ব শ্রীরামচন্দ্রকে মায়া-মানুষ জ্ঞান করে, তাহাদিগকে প্রতারণা করিবার জন্য শ্রীরামচন্দ্র স্বীয় দুর্বলতা বা আশ্রিত-বাৎসল্য প্রদর্শন করিতেছেন।
এবার হনুমান চরিত্রের বিচার হল,- রামভক্ত হনুমানের রাবণের ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হইয়া রাবণ ভোগ্য লঙ্কা দহন। হনুমানের ঐরূপ কার্য্য আদৌ অন্যায় বা নীতিগর্হিত নহে। যে ব্যক্তি সেব্য বস্তুকে লঙ্ঘন করে, প্রাকৃত সেবক তাহাকে সমুচিত দণ্ড প্রদান করিয়া সেব্যের প্রতি সেবার চমৎকারীতা প্রদর্শন করেন। ইহাতে শিক্ষা কি? না, শ্রীরামসেবক ব্জ্রাঙ্গজী বিকারী জগতের পরিণামশীলতা প্রদর্শন করিতেছেন। প্রভুর জন্য ভক্তের ইহাই একমাত্র কৃত্য যে, ভক্ত এইরূপ কার্য্যে বিমুখ হইলে তাহার প্রভুসেবা বিলুপ্ত হইয়া যায় এবং তাহাতে আত্মতৃপ্তি ও জড় ভোগীগণের মনস্কামনার সিদ্ধি হয়।
সমুদ্রের সেতুবন্ধন কার্য্যে ক্ষুদ্র কাঠবিড়ালিগণও নানাপ্রকার সেবা চেষ্টা প্রদর্শন করিতেছেন। ভগবান শ্রীরাম তাহাদেরও সেবা অঙ্গীকার করিয়া পুরস্কৃত করিলেন। করুণাময় ভগবান অতি দুর্বল ব্যক্তিকেও সেবাধিকার প্রদান করেন। সবল ও যোগ্যতর ব্যক্তিগণ যেরূপ স্ব স্ব সেবানৈপুণ্য প্রদর্শন করেন, দুর্বল ব্যক্তিগণও নিজ নিজ স্বল্প যোগ্যতানুসারে সেবার পূর্ণতা সম্পাদনে তদ্রূপ ব্যগ্র। অতএব শিক্ষার বিষয় হল, ভগবান অকপট সেবকের সেবা চেষ্টাও স্বীকার করিয়া থাকেন। অর্থাৎ অকপট ভক্তি সর্ববিষয়ে ও সর্ব সময়ে ভগবান কর্তৃক গৃহীত হইয়া থাকে। মহাদেব, নারদ প্রভৃতি মহাজনগণ যাঁহার সেবক, আমি অতি ক্ষুদ্রজন, সেই মহানের সেবা বিধান কিরূপে করিব! – সেবায় এইরূপ ব্যাকুলতারূপ আত্মধর্ম হইতে বঞ্চিত না হইয়াই সকলের কামনা হওয়া উচিত।
পতিব্রতা-শিরোমণি জনক-নন্দিনী।
জগতের মাতা সীতা, রামের গৃহিণী।।
রাবণ দেখিয়া সীতা লৈল অগ্নির শরণ।
রাবণ হৈতে অগ্নি কৈল সীতাকে আবরণ।।
সীতা লঞা রাখিলেন পার্বতীর স্থানে।
‘মায়াসীতা’ দিয়া অগ্নি বঞ্চিলা রাবণে।।
রঘুনাথ আসি যবে রাবণে মারিল।
অগ্নি পরীক্ষা দিতে সীতারে আনিল।।
তবে মায়া সীতা, অগ্ন্যে কৈল অন্তর্দ্ধান।
সত্যসীতা আনি’ দিল রাম বিদ্যমান।।
(চৈ চ- ৯/২০২-২০৩, ২০৫-২০৭)
সীতইয়ারাধিতো বহ্নিশ্ছায়া সীতাজীজনৎ।
তাং জহার দশগ্রীবঃ সীতা বহ্নিপুরং গতা।।
পরীক্ষা সময়ে বহ্নি ছায়া-সীতা বিবেশ সা।
বহ্নি সীতাং সমানীয় তৎপুরস্তাদনীনয়ৎ।।
(শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত- মধ্য-৯/২১১-২১২ ধৃত কূর্ম্মপুরাণ বচন)
[ “সীতা কর্তৃক প্রার্থিত হইয়া অগ্নি ‘ছায়াসীতা’ প্রস্তুত করিলেন। দশগ্রীব রাবণ ছায়াসীতা হরণ করিয়াছিল; মূলসীতা বহ্নিপুরে রহিলেন। রামচন্দ্র যখন পরীক্ষা করেন, ছায়াসীতা বহ্নি মধ্যে প্রবেশ করিলেন, অগ্নিদেব মূলসীতাকে আনিয়া রামচন্দ্রের নিকটে উপস্থিত করিলেন”।]
Tuesday, March 28, 2017
শ্রীরামলীলা-তত্ত্ব ও শিক্ষা
Hey visitor! I'm Satyajit Roy holding a big name of famous indian film director! but not for nothing at all ��. Trying to write something about something.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment