যুগনায়ক বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাচেতনায় উপনিষদের প্রভাব ছিল অপরিসীম। তিনি ছিলেন একাধারে কর্মযোগী, জ্ঞানযোগী ও ভক্তিযোগী। তিনি বেদান্তের অদ্বৈতবাদের ওপর নতুন আলোকপাত করেছিলেন এবং বেদান্তকে ব্যবহারিক জীবনে কি ভাবে প্রয়োগ করতে হয় তাও শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর মতে দ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতাবাদ ও অদ্বৈতবাদ ধর্মসাধনার ভিন্ন ভিন্ন স্তর, আর ছান্দোগ্য উপনিষদের আপ্তবাক্য ‘তত্ত্বমসি(তৎ ত্বম্ অসি)’(ছান্দোগ্য
-৬/৮/৭) অর্থাৎ ‘তুমিই তিনি’ বা বৃহদারণ্যক উপনিষদের মহাভাষ্য ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’(বৃহদারণ্যক-১/৪/১০) অর্থাৎ ‘আমিই ব্রহ্ম’ হচ্ছে উপলব্ধির শেষ কথা। অদ্বৈতবাদী বলেন “জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।” জীবে ও ব্রহ্মে কোনো ভেদ নেই। উপনিষদে অদ্বৈত ভাবের প্রতিপাদক অনেক বচন আছে; ব্রহ্ম যে নির্গুণ এবং সৃষ্টি যে মায়া-কল্পিত, এ-কথাও বলা হয়েছে। তাই স্বামিজী উপনিষদের নানা বচন উদ্ধৃত করে নিজের বক্তব্য প্রতিপাদন করেছেন।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ আত্মার অমরতার কথা বলে অর্জুনকে ক্লৈব্য পরিহার (‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ’ - শ্রীমদ্ভগবদ্গ
ীতা-২/৩) ও ভয়শূন্য (‘ন বিকম্পিতুম্’ - শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-২/৩১) হবার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু কঠোপনিষদের বীর্যবান ও শ্রদ্ধাবান নচিকেতার চরিত্রই স্বামিজীকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। পিতা ঋষি বাজশ্রবসের যজ্ঞকালে বালক নচিকেতার শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়েছিল। স্বামিজী বলেছেন এই ‘শ্রদ্ধা’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে ‘শ্রদ্ধা’ বলতে বোঝায় সংকল্পসাধনে অবিচলিত নিষ্ঠা যা মানুষকে সহস্র প্রলোভন জয় করতে শিক্ষা দেয়, যে নিষ্ঠার ফলে মানুষ ধর্মের পথ থেকে, সত্যের পথ থেকে ভ্রষ্ট হয় না।
কঠোপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম বল্লীতে আত্মতত্ত্ব প্রসঙ্গে একটি আখ্যায়িকার অবতারণা করা হয়েছে। মৃত্যুরাজ যম নচিকেতাকে তিনটি বর দিতে চেয়েছিলেন। নচিকেতা প্রথম দুটি বরে পিতার যজ্ঞত্রুটি থেকে ক্ষমালাভ ও স্বর্গলাভের সাধনভূত অগ্নিবিদ্যা প্রার্থনা করে সহজেই তা’ লাভ করলেন। তৃতীয় বরে নচিকেতা পরলোকের রহস্য জানতে চাইলেন-
যেয়ং প্রেতে বিচিকিৎসা মনুষ্যে অস্তীত্যেকে নায়মস্তীতি চৈকে।
এতদ্ বিদ্যামনুশিষ্টস্ত্বয়াহ্হং বরাণামেষ বরস্তৃতীয়ঃ।। (কঠোপনিষদ-১/১/২০)
(কেউ বলেন মৃত্যুর পর আত্মা থাকে, কেউ বলেন আত্মা থাকে না। পরলোক সম্বন্ধে মানুষের মনে এই যে সন্দেহ বিদ্যমান সেই আত্মার তত্ত্ব আমি সম্যক জানতে ইচ্ছা করি)
মৃত্যুরাজ যম নচিকেতার এই মহাজ্ঞান লাভের যোগ্যতা পরীক্ষা করার জন্য তাঁকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তত্ত্ব-জিজ্ঞাসু বালক কোনো প্রলোভনেই বিচ্যুত হলেন না। তখন যম তাঁকে বলেছিলেন(কঠোপনিষদ-১/২/১)-
অন্যৎ শ্রেয়োহ্ন্যদুতৈব প্রেয়স্তে উভে নানার্থে পুরুষং সিনীতঃ।
তয়োঃ শ্রেয় আদদানস্য সাধু ভবতি হীয়তেহ্র্থাদ্ য উ প্রেয়ো বৃণীতে।।
(‘শ্রেয়’ অর্থাৎ কল্যাণকর বস্তু এবং ‘প্রেয়’ অর্থাৎ প্রীতিকর বস্তু এক নয়। শ্রেয়র প্রয়োজন মুক্তিলাভে, প্রেয়র প্রয়োজন ঐহিক সুখভোগে। যিনি শ্রেয়কে গ্রহণ করেন তাঁর কল্যাণ হয়, যিনি প্রেয়কে বরণ করেন তিনি পরমার্থ হতে বিচ্যুত হন।)
যমরাজ বললেন ‘তুমি বালক হয়েও যে প্রেয়র পথকে পরিহার করে শ্রেয়র পথ বেছে নিয়েছ সে জন্য তুমি প্রশংসার যোগ্য’। তারপর যম নানাভাবে আত্মতত্ত্ব ও আত্মজ্ঞান লাভের উপায় বিবৃত করে বললেন- উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।
ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দূরত্যয়া
দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।। (কঠোপনিষদ-১/৩/১৮)
(উত্থিত হও, মোহনিদ্রা ত্যাগ করে জাগ্রত হও, শ্রেষ্ঠ আচার্যগণের সমীপে গমন করে আত্মতত্ত্ব জ্ঞাত হও; যাঁরা ক্রান্তদর্শী তাঁরা বলেন- আত্মজ্ঞানের পথ ক্ষুরধারের মতো দুর্গম, দূরতিক্রমণীয়।)
স্বামিজী-প্রবর্তিত মাসিকপত্র ‘উদ্বোধন’-এর মটো ছিল ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্নিবোধত’। স্বামিজী তাঁর অনেক বক্তৃতায় এই বচনটি উদ্ধৃত করে ইংরেজিতে এর ভাবানুবাদ করেছেন ‘Awake, arise and stop not till the goal is reached’ – জাগো, উঠে দাঁড়াও এবং লক্ষ্যে না পৌঁছান পর্যন্ত থেমো না।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে ঋষি মানুষকে অমৃতের পুত্র বলে সম্বোধন করে বলেছেন ‘শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ’(শ্বেতাশ্বতর-২/৫)। বলেছেন মৃত্যুকে অতিক্রম করার পন্থা- ‘বেদাহ্মেতং পুরুষং মহান্তম্ আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ। তমেব বিদিত্বাহ্তি মৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহ্য়নায়।।’ (শ্বেতাশ্বতর-৩/৮)। রবীন্দ্রনাথ এই দিব্যচেতনার শ্রুতিনন্দন অনুবাদ করেছেন ‘নৈবেদ্য’ কাব্যে-
‘শোনো বিশ্বজন,
শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
দিব্যধামবাসী, আমি জেনেছি তাঁহারে,
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময়। তাঁরে জেনে, তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পার, অন্য পথ নাহি’।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে মৈত্রেয়ীর প্রতি যাজ্ঞবল্ক্যের উপদেশে অমৃতত্ব লাভের উপায় বর্ণিত হয়েছে। মৈত্রেয়ীর জিজ্ঞাসা ‘যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাং?’- যা দিয়ে অমরত্ব লাভ করতে পারব না, তা দিয়ে কি করব?(বৃহদারণ্যক
-২/৪/৩)। এই তো ভারতাত্মার চিরন্তন জিজ্ঞাসা, যার প্রতিধ্বনি বাইবেলে What profits us if we gain the world but lose our soul? উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য বলেছিলেন ‘আত্মনস্তু কামায় সর্বং প্রিয়ং ভবতি’- সংসারে যা কিছু আমাদের প্রিয় তা আত্মার জন্যই(বৃহদারণ্যক-২/৪/৫)। জীবদেহ নশ্বর, জীবের আত্মা অবিনশ্বর। ঊনবিংশ শতকের ইংরেজ কবি লংফেলোর কবিতায় প্রতিফলিত একই চেতনা Dust thou art, to dust returnest was not spoken of the soul। এই আত্মাকে জানতে হবে। আত্মজ্ঞানী জরামৃত্যু-জনিত শোক উত্তীর্ণ হয়ে অমৃতত্ব লাভ করেন, আত্মাতেই যাঁর আনন্দ তিনিই স্বাধীন – সম্পূর্ণরূপে অপরতন্ত্র(ছান্দোগ্য-৭/২৫/২)। মুণ্ডক উপনিষদে আত্মাকে বলা হয়েছে ‘আনন্দরূপমমৃতম্’(মুণ্ডক-২/২/৮)- আনন্দময় আত্মা অমৃতস্বরূপ। মাণ্ডুক্য উপনিষদে(মাণ্ডুক্য/২) বলা হয়েছে এই আত্মাই ব্রহ্ম(‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’)। শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন বা নিশ্চিন্তরূপে ধ্যানের দ্বারাই আত্মাকে বা ব্রহ্মকে জানা যায়। এবং যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি ব্রহ্মই হন- ‘যঃ ব্রহ্ম বেদ সঃ ব্রহ্মৈব ভবতি’(মুণ্ডক-৬৩)। অদ্বৈত বেদান্তরও সিদ্ধান্ত এই। স্বর্গ বা নরক ভোগ জীবের চরম গতি নয়। যা থেকে জীবের উদ্ভব সেই পরমব্রহ্মে লীন হওয়া জীবের পরম লক্ষ্য। বৃহদারণ্যক উপনিষদে যে জীবন্মুক্তিবাদ স্বীকৃত বৈদান্তিকগণও সেই জীবন্মুক্তির কথাই বলেছেন। স্বামিজীও এই ত্রিবিধ সাধনের দ্বারা আত্মোপলব্ধির কথা প্রচার করেছেন।
ঈশোপনিষদের প্রথম শ্লোকে রয়েছে-
‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ’
এই গতিশীল জগতের সব কিছুতে ঈশ্বর অভিব্যক্ত আছেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদেও (২/৫/১৮) অদ্বৈতবাদের মূল সূত্রে রয়েছে-
‘নৈনেন কিঞ্চনানাবৃতং নৈনেন কিঞ্চনাসংবৃতম্’
এমন কিছু নেই যা ঈশ্বরের দ্বারা আবৃত নয়, এমন কিছু নেই যাতে ঈশ্বর অনুপ্রবিষ্ট নন। আত্মোপলব্ধির দ্বারাই ঈশ্বর উপলব্ধি হয়। মুণ্ডক উপনিষদে বলা হয়েছে ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য’(মুণ্ডক-৩/২/৪)- বলহীন ব্যক্তি এই আত্মাকে লাভ করতে পারে না। ‘বল’ শব্দে শুধু শারীরিক বা মানসিক বল নয়, আত্মনিষ্ঠা এবং আত্মজ্ঞান লাভের জন্য একাগ্রতার দ্বারা যে বীর্য লাভ হয় তাকেই ‘বল’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কেন উপনিষদেরও শ্রেষ্ঠ বাক্য ‘আত্মানাং বিন্দতে বীর্যং’(কেন-২/
৪) – আত্মার জ্ঞান থেকে বীর্য লাভ হয়। এই বল যাদের নেই, যাদের দুর্বল চিত্ত বিষয়-কামনা, সংসারের প্রলোভন দ্বারা বিক্ষিপ্ত তারা আত্মাকে লাভ করতে পারে না। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন উপনিষদ আমাদের ‘অভীঃ’ বা অভয় মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছে। ‘অভীঃ’ মন্ত্রই স্বামিজী দিগ্দিগন্তে প্রচার করেছেন। তাঁর মতে ধর্ম-সাধনার প্রধান লক্ষণই হচ্ছে ভয়শূন্য হওয়া।
স্বামী বিবেকানন্দ উপনিষদের বাণীর উপর নূতন আলোকপাত করেছেন। তিনি শিখিয়েছেন- উপনিষদ বা বেদান্ত আমাদের শুধু প্রজ্ঞাবান করে না, বীর্যবান ও শক্তিমান করে তোলে। আর যিনি বৈদান্তিক, তিনিই যথার্থ কর্মযোগী হতে পারেন। আধুনিক কালে তিনি নূতন আলোকে বেদান্তচর্চার সূত্রপাত করেছেন। নূতন যুগের দিব্যদূত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
পরিশেষে ১৩২৯ সনের ১৪ই কার্তিক তারিখের ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা থেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ‘আমি সৈনিক’-এর অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি-
“এখন দেশে সেই সেবকের দরকার যে সেবক দেশ-সৈনিক হ’তে পারবে। রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, প্রফুল্ল বাঙলার দেবতা, তাঁদের পূজার জন্য বাঙলার চোখের জল চিরনিবেদিত থাকবে। কিন্তু সেনাপতি কই? কোথায় আঘাতের দেবতা, প্রলয়ের মহারুদ্র? সে পুরুষ এসেছিলেন- বিবেকানন্দ, সে সেনাপতির পৌরুষ-হুঙ্কার গর্জে উঠেছিল বিবেকানন্দের কন্ঠে।”
Tuesday, March 21, 2017
উপনিষদ ও স্বামী বিবেকানন্দ
Hey visitor! I'm Satyajit Roy holding a big name of famous indian film director! but not for nothing at all ��. Trying to write something about something.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment