Hare Krishna

Hare Krishna
Welcome to ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ

Tuesday, March 21, 2017

প্রকৃতি ও মানুষ

বিশ্বজগতের যেটুকু অংশে ভৌতিক স্তরে অভিব্যক্ত, শুধু সেইটুকুই প্রকৃতি-সম্বন্ধে আধুনিক ধারণার অন্তর্গত। মন বলতে সাধারণতঃ যাহা বুঝায়, তাহা প্রকৃতিরূপে বিবেচিত হয় না।ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতা প্রতিপন্ন করতে গিয়ে দার্শনিকগণ মনকে প্রকৃতি হতে বাদ দিয়া থাকবেন, কারণ প্রকৃতি নিয়মের—কঠোর অনমনীয় নিয়মের শাসনে আবদ্ধ, প্রকৃতির অন্তর্গত বিবেচিত হলে মনও নিয়মের অধীন হয়ে পড়বে। ফলে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির মতবাদ দাঁড়াতে পারবে না; কেন না যাহা কোন নিয়মের অধীন, তাহা কিরূপে স্বাধীন বা স্বতন্ত্র হতে পারে?যুক্তি ও তথ্যের উপর দণ্ডায়মান ভারতীয় দার্শনিকগণের দৃষ্টিভঙ্গী এ-বিষয়ে বিপরীত। তাঁদের মতে—ব্যক্ত অথবা অব্যক্ত সমগ্র বাস্তব জীবনই নিয়মের অধীন। তাঁদের মতে: মনও বাহ্য প্রকৃতি, দুই-ই নিয়মের—একই নিয়মের অধীন। মন যদি নিয়মের অধীন না হয়, আমরা এখন যা চিন্তা করতেছি, তাহা যদি পূর্ব চিন্তার অনিবার্য ফলস্বরূপ না হয়, যদি একটি মানসিক অবস্থা আর একটি মানসিক অবস্থার অনুসরণ না করে, তবে মনকে অযৌক্তিক বলতে হবে। এমন কে আছে, যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি স্বীকার করে যুক্তির ক্রিয়া অস্বীকার করতে পারে? অপর পক্ষে মন কার্য-কারণ নিয়ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, ইহা স্বীকার করেই কে বলতে পারে যে, ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন?নিয়মই কার্য-কারণের ক্রিয়া। পূর্ববর্তী কতকগুলি ঘটনার অনুযায়ী হয়ে পরবর্তী কতকগুলি ব্যাপার ঘটে থাকে। প্রতিটি পূর্বগামী ঘটনার বা কারণের অনুবর্তী কার্য আছে। প্রকৃতি এরূপেই চলেছে। এই নিয়মের শাসন যদি মনের স্তরেও চালু থাকে, তাহলে মন বদ্ধ—স্বাধীন নয়। না, ইচ্ছাশক্তিও স্বাধীন নয়। ইহা কিভাবে সম্ভব? কিন্তু আমরা সকলেই জানি, অনুভব করি যে, আমরা স্বাধীন। স্বাধীন না হলে আমাদের জীবনের কোন অর্থ থাকে না, জীবনযাপন বৃথা হইয়ে যায়।প্রাচ্যদেশীয় দার্শনিকগণ এই মতবাদ গ্রহণ করেছেন, বা বলা যায়—উদ্ভাবন করেছেন যে, মন এবং ইচ্ছাশক্তি দেশকালনিমিত্তের দ্বারা তথা- কথিত জড়বস্তুর মতোই বদ্ধ; সুতরাং উহারা কার্যকারণের নিয়মে শাসিত। আমরা কালের মধ্যে চিন্তা করি, আমাদের চিন্তাগুলি কালের দ্বারা সীমিত; যা কিছুর অস্তিত্ব আছে, সে সব কিছুই দেশে ও কালে বর্তমান। সব কিছুই কার্য-কারণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ।যাকে আমরা জড়পদার্থ বলি, এবং মন—এ দুইই একই উপাদানে গঠিত। প্রভেদ কেবল কম্পনের তারতম্যে। মনের অতি নিম্নগ্রামের স্পন্দনকেই আমরা জড়বস্তু বলে জানি। আবার জড়পদার্থের দ্রুত স্পন্দনকে আমরা মন বলে জানি। উভয়ের উপাদান একই। অতএব জড়পদার্থ এবং দেশকালনিমিত্ত্বের দ্বারা সীমিত বলে জড়ের দ্রুত স্পন্দন মনও একই নিয়মের দ্বারা আবদ্ধ।প্রকৃতির উপাদান সর্বত্র সমজাতীয়। প্রভেদ কেবল বিকাশের তারতম্যে। এই বিশ্বপ্রপঞ্চের সংস্কৃত প্রতিশব্দ হইল 'প্রকৃতি' এবং এর আক্ষরিক অর্থ 'প্রভেদ'। সবই এক উপাদান, কিন্তু ইহা বিচিত্ররূপে অভিব্যক্ত।মন জড়ে রূপান্তরিত হয়, আবার জড়ও মনে রূপান্তরিত হয়, ইহা শুধু কম্পনের তারতম্য।একটি ইস্পাতের দণ্ড লও, উহাকে কম্পিত করতে পারে—এইরূপ একটি শক্তি এতে প্রয়োগ কর; তারপর কি ঘটবে? যদি একটি অন্ধকার ঘরে এই পরীক্ষাটি করা হয়, তবে প্রথমে তুমি শুনিতে পাবে একটি শব্দ—একটি গুনগুন শব্দ। শক্তিপ্রবাহ বর্ধিত কর, দেখিবে ইস্পাতের দণ্ডটি আলোকময় হয়ে উঠেছে। শক্তি আরও বর্ধিত কর, ইস্পাতের দণ্ডটি আলোকময় হয়ে উঠিয়াছে। শক্তি আরও বর্ধিত কর, ইস্পাত-দণ্ডটি একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে। উহা মনে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।আর একটি উদাহরণ লও: দশদিন আহার না করলে আমি কোনপ্রকার চিন্তা করতে পারি না। শুধু কয়েকটি এলোমেলো চিন্তা আমার মনে থাকবে। আমি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ব এবং সম্ভবতঃ আমার নামও ভুলে যাব। তারপর কিছু খাদ্য গ্রহণ করলাম এবং কিছুক্ষণের মধ্যে চিন্তা করতে আরম্ভ করব; আমার মনের শক্তি ফিরে আসছে। খাদ্যই মনে রূপান্তরিত হয়েছে। তেমনি স্পন্দনের গতিবেগ কমিয়ে মন দেহে অভিব্যক্ত হয়, জড়ে পরিণত হয়।জড় ও মন—এ দুইটির কোনটি প্রথম? একটি উদাহরণসহ বুঝাইতেছি—একটি মুরগী ডিম পাড়ল, ডিমটি হতে আর একটি মুরগীর জন্ম হল;মুরগীটি আর একটি ডিম পাড়ল; ডিমটি হতে আবার আর একটি মুরগী জন্মিল; অনন্ত কার্যকারণ-পরম্পরা এইরূপ চলতে থাকবে। এখন কোন্টি প্রথম—ডিম, না মুরগী? এমন কোন ডিমের কথা কল্পনা করতে পার না, যাহা কোন মুরগী হতে জন্মে নাই; অথবা এমন কোন মুরগীর বিষয় চিন্তা করতে পার না, যাহা ডিম হতে ফুটে নাই। যেটিই প্রথম হোক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। আমাদের প্রায় সব চিন্তাধারাই এই ডিম ও মুরগীর ব্যাপারের মতো১।১ তুলনীয় : বীজাঙ্কুর-ন্যায়মহত্তম সত্যগুলি অত্যন্ত সরল বলেই বিস্মৃতির গর্ভে চলে যায়। মহৎ সত্যগুলি সহজ, কেন না এগুলির প্রয়োগ সার্বকালিক। সত্য নিজেই সর্বদা সহজ ও সরল। যা কিছু জটিল, তা কেবল মানুষের অজ্ঞতার জন্য।মানুষের স্বতন্ত্র কর্তৃত্ব মনেতে নাই, কেন না মন বদ্ধ। সেখানে কোন স্বাধীনতা নাই। মানুষ মন নয়, আত্মা। এই আত্মা সর্বদা মুক্ত, সীমাহীন ও চিরন্তন। এইখানেই—এই আত্মাতেই মানুষের মুক্তভাব। আত্মা সর্বদাই মুক্ত; কিন্তু মন উহার ক্ষণস্থায়ী তরঙ্গগুলির সঙ্গে নিজেকে এক মনে করে আত্মাকে দেখতে পায় না এবং দেশকালনিমিত্ত-রূপ গোলকধাঁধায়—মায়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে।ইহাই আমাদের বন্ধনের কারণ। আমরা সর্বদা মন এবং মনের অদ্ভুত পরিবর্তনগুলির সঙ্গে নিজেদের এক ভাবছি।মানুষের স্বতন্ত্রভাব আত্মাতেই অবস্থিত এবং নিজেকে মুক্ত উপলব্ধি করেই—মনের বন্ধন সত্ত্বেও সর্বদা ঘোষণা করছে: আমি মুক্ত! আমি যা, আমি তাই; আমি সেই। ইহাই আমাদের মুক্তি। সদামুক্ত সীমাহীন চিরন্তন আত্মা যুগে যুগে তাঁহার মন-রূপ যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্রমে ক্রমে অধিকতর ব্যক্ত হয়েছেন।তাহা হলে মানুষের সহিত প্রকৃতির সম্পর্ক কি? জীবের নিম্নতম বিকাশ হতে মানব পর্যন্ত—সর্বত্রই প্রকৃতির মধ্য দিয়া আত্মা বিকশিত হতেছেন। নিম্নতম অভিব্যক্ত জীবনের মধ্যেও আত্মার শ্রেষ্ঠ বিকাশ নিহিত আছে, ক্রমবিকাশের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মা নিজের বিকাশ সাধন করছেন। বিবর্তনের সমগ্র প্রক্রিয়াই আত্মার নিজেকে ব্যক্ত করবার সংগ্রাম। ইহা প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম। প্রকৃতির অনুযায়ী কাজ করে নয়, তাহার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই মানুষ আজ বর্তমান অবস্থা লাভ করেছে। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবনধারণ করা, প্রকৃতির সঙ্গে একতানতা রক্ষা করা প্রভৃতি সম্বন্ধে বহু কথাই আমরা শুনে থাকি। এরূপ ধারণা ভ্রম। এই টেবিলটি, এই জলের কুঁজাটি, এই খনিজ পদার্থগুলি, ঐ বৃক্ষ—এরা সকলেই প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখিয়া চলছে। সেখানে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য বিদ্যমান—কোন বিরোধ নাই। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের অর্থ নিশ্চেষ্টতা, মৃত্যু। মানুষ এই গৃহ কিরূপে নির্মাণ করেছে—প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে? না, প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ইহা নির্মিত হয়েছে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের পথেই মানুষের উন্নতি, প্রকৃতির অনুগত হয়ে নয়।
সুত্র- স্বামী বিবেকানন্দের বাণী এবং রচনা।

No comments:

Post a Comment