আমাদের পারমার্থিক কর্মে বা শাস্ত্র পাঠে একটি বিষয় আলোচিত হয় যে, এখানে তোমার অধিকার নেই ওখানে আছে! কেন এমন? কি ছিল বৈদিক ঋষিদের উদ্দেশ্য ?
আজকের বিষয় অধিকারীঃ ‘অধিকারী’ বলতে এখানে বেদান্তশাস্ত্রের তাৎপর্য অনুধাবনের অধিকারসম্পন্ন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। যিনি বেদান্তশাস্ত্রের বিষয় বুঝতে, শাস্ত্রের নির্দেশ যত্নসহকারে পালন করতে এবং সদা সৎকর্মে ব্যাপৃত থাকতে সক্ষম, তিনিই বেদান্ত দর্শনের মর্মকথা অনুধাবনের অধিকারী। এজন্যেই অধিকারীকে প্রথমত ব্রহ্মচর্যাদির অনুষ্ঠানপূর্বক শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, জ্যোতিঃশাস্ত্র এবং ছন্দঃশাস্ত্র, এই ছয়টি অঙ্গের সাথে বেদ অধ্যয়ন করবে। এভাবে বেদ অধীত হলে আপাতত বেদার্থের অবগতি হবে। কাম্যকর্ম ও নিষিদ্ধকর্মের অনুষ্ঠান করলে অনুষ্ঠিত কর্মের ফলভোগের জন্য শরীর-পরিগ্রহ বা জন্ম অবশ্যম্ভাবী। শরীরপরিগ্রহ এবং কর্মফলভোগ, উভয়ই বন্ধনের হেতু বা বন্ধন। বন্ধনাবস্থায় মুক্তি অসম্ভব। কারণ, বন্ধন ও মুক্তি পরস্পরবিরুদ্ধ। অতএব কাম্য ও নিষিদ্ধ কর্ম বর্জন করবে। এবং নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান করবে। তাই ‘বেদান্তসার’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, যিনি বিধিপূর্বক বেদ-বেদান্ত অধ্যয়ন করে তার মূলমর্ম গ্রহণ করেছেন এবং ইহজন্মে বা জন্মান্তরে কাম্য কর্ম ও শাস্ত্রনিষিদ্ধ কর্ম ত্যাগপূর্বক কেবল নিত্য কর্ম, নৈমিত্তিক কর্ম ও প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠানের দ্বারা নিষ্পাপ ও নির্মলচিত্ত হয়েছেন, তিনিই বেদান্ত পাঠের অধিকারী। বেদান্তের অধিকারী সাধন-চতুষ্টয়ের অনুসরণ করে থাকেন। এই সাধন-চতুষ্টয় হলো- (১) বিবেক, (২) বৈরাগ্য, (৩) সাধন-সম্পত্তি ও (৪) মুমুক্ষুত্ব।
‘বিবেক’ বলতে বোঝায় নিত্যানিত্যবস্তুবিবেক। অর্থাৎ কোন্ বস্তু নিত্য, কোন্ বস্তু অনিত্য, নিত্য ও অনিত্য বস্তুর ভেদ কী প্রভৃতি বিষয়ের জ্ঞানই হলো বিবেকজ্ঞান। এই জ্ঞানের দ্বারাই কোন্ বস্তু গ্রহণীয় এবং কোন্ বস্তু বর্জনীয়, তা নির্ধারণ করা সম্ভব। ‘বৈরাগ্য’ বলতে বোঝায় ঐহিক ও পারলৌকিক সকল প্রকার সুখের প্রতি বিরাগ। ‘সাধনসম্পত্তি’ বলতে বোঝায় শম্, দম্, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান ও শ্রদ্ধা। ‘মুমুক্ষুত্ব’ বলতে বোঝায় ব্রহ্মোপলব্ধি তথা মোক্ষলাভের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা।
এখানে উল্লেখ্য, আত্মসাক্ষাৎকারের উপযোগী শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন এবং তার অনুকুল বিষয় ছাড়া অন্যান্য সমস্ত বিষয় থেকে অন্তঃকরণের নিয়ন্ত্রণ বা নিগ্রহের নাম শম, এবং এসব বিষয় থেকে বাহ্যকরণ অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের নিগ্রহকে দম বলা হয়। উপরতি হলো সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণপূর্বক শাস্ত্রবিহিত কার্যকলাপ পরিত্যাগ। তিতিক্ষা হলো শীত-তাপ, সুখ-দুঃখ, মান-অপমান ইত্যাদি পরস্পরবিরুদ্ধ প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও কষ্টসহিষ্ণু থাকা। দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদি এবং তার অনুকুল বিষয়ে মনের সমাধি বা একাগ্রতা অর্থাৎ তৎপরতার নাম সমাধান। আর গুরুবাক্য এবং বেদান্তবাক্যে বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা বলা হয়।
ক্রমশঃ
নিবেদনে - শ্রীমদ্ভগবদগীতা স্কুল।
No comments:
Post a Comment