Hare Krishna

Hare Krishna
Welcome to ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ

Saturday, June 24, 2017

শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার মাহাত্ম্য

শাস্ত্রে আছে 'রথস্থ বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে'। রথের ওপর খর্বাকৃতি বামন শ্রী শ্রী জগন্নাথকে দর্শন করলে তার পুনর্জন্ম হয় না। এ বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করে ভোর হতেই ভক্তরা প্রাণের টানে ছুটে আসেন প্রেমোরথের প্রাণের ঠাকুরকে নিয়ে স্নানযাত্রার উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ রথের রশি ধরে টানতে। রথটানা শুরু করতেই আশ্চর্যভাবে অনেকটা ভারাক্রান্ত ও বেদনাচ্ছন্ন হয়ে ঘন মেঘ দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে মাটির পৃথিবীতে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়ে। সেই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে নেচেগেয়ে উচ্ছ্বাসের প্লাবনে মতোয়ারা হন সবাই। সেই সঙ্গে সমানতালে বাজতে থাকে ঘণ্টাবাদ্যি। একদিকে পুরুষেরা শঙ্খ, ঘণ্টা, কাঁসা, ঢাক, ঢোল বাজিয়ে পরিবেশ মুখর করে তোলেন অন্যদিকে নারীরা উলুধ্বনি ও মঙ্গলধ্বনির মাধ্যমে রথটানায় আনন্দচিত্তে শামিল হন। রথ থেকে রাস্তায় দাঁড়ানো দর্শনার্থীদের দিকে ছুড়ে দেয়া হয় কলা আর ধানের খৈ।
প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়। শ্রীকৃষ্ণের দ্বাপর যুগে লীলা সম্বরণের পরবর্তী সময়ে জগন্নাথ, বলরাম, সুভ্রদা-এ তিন রূপের পুনঃউদঘাটন এক আশ্চর্য সংবাদও বটে। শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় সমাগম হয় লাখ লাখ ভক্তের, যার ফলে সৃষ্টি হয় সমন্বয় ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা। সেই সঙ্গে রথ থেকে দেয়া হয় আশীর্বাদ ও প্রসাদ ভক্তবৃন্দ তা গ্রহণ করে হন কৃতার্থ। রথে থাকেন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা। ভক্তবৃন্দ ভক্তি সহকারে রথরজ্জুর মাধ্যমে রথকে টেনে এগিয়ে নিয়ে যান। আর এ দৃশ্য দেখার জন্য আবেগপ্রবণভাবে ভক্তবৃন্দ এবং বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মানুষ অবস্থান নেন। কারণ রথরজ্জু ধরে রথটানা মহাপুণ্য কর্ম বলে সনাতন ধর্মে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
কঠোপনিষদ বলেছেন, 'আত্মা হলো রথী, শরীর হলো রথ, বুদ্ধি হলো সারথি, মন হলো লাগাম। মনীষীরা ইন্দ্রিয়গুলোকে দেহরথের অশ্ব বিষয়গুলোকে ইন্দ্রিয়গুলোর বিচরণ ভূমি এবং দেহ-মন ও ইন্দ্রিয়যুক্ত আত্মাকে ভোক্তা বলেছেন। যে পুরুষের সারথি (বুদ্ধি) অসংযত মনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অবিবেকী হয় তার ইন্দ্রিয় সব লৌকিক সারথির দুষ্টু অশ্বের মতো আপন বশে থাকে না। কিন্তু যার বুদ্ধি বিবেকবান, মন সংযত, যার অন্তঃকরণ সর্বদা পবিত্র, তিনি সেই পরম পদপ্রাপ্ত হন। তাকে আবার আর সংসারে জন্মগ্রহণ করতে হয় না। সে পরমপদ প্রাপ্তি অর্থাৎ অভীষ্ট লক্ষ্যের পথ অতি দুর্গম, এ জন্য উপযুক্ত 'যান' প্রয়োজন। 'রথ' পথযাত্রার একটি প্রকৃষ্ট যান। এ রথের সুযোগ্য চালক বা সারথি প্রয়োজন, তার সঙ্গে প্রয়োজন শক্তিশালী বশীভূত তথা বিশ্বস্ত অশ্ব ও সুদৃঢ় লাগাম। শাস্টত্রকাররা রূপক ছলে বলেছেন, অবিদ্যাবশে সংসারী জীবনের এ দেহটাই 'রথ' এবং রথের অধিষ্ঠাতা আত্মীয় 'রথী'। সুতরাং, প্রাণ থাকা পর্যন্ত দেহকে অবহেলা করতে নেই। তাই ঋষিরা বলেছেন, আত্মা নং বিদ্ধি আত্মাকে জানো, রথযাত্রায় চরম আধ্যাত্মিক রহস্যকে সূক্ষ্ম রূপে তুলে ধরা হয়েছে। প্রেমিবিগলিত জগন্নাথের দেহটির বর্ণনা গৌড়ীয় দর্শনের আচার্যরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে- ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকালীলায় ১৬ হাজার আটজন প্রধান মহিষীকে নিয়ে চরম বিলাস করেছেন। কিন্তু প্রায়ই রাতে 'রাধা' 'রাধা' বলে চিৎকার করে কাঁদা দেখে একদিন সত্যভামাসহ মহিষীরা কান্নার কারণ জানার জন্য মা রোহিনীর কাছে উপস্থিত হলেন এবং জানার প্রত্যাশা নিবেদন করলেন। বন্ধুদের ব্যাকুলতা দেখে অন্তঃপূরের দরজায় সুভদ্রা বোনকে পাহারা দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করে বৃন্দাবনের প্রেমলীলাতত্ত্বের ওপর বক্তব্য শুরু করেন। এই প্রেক্ষাপটে বলরাম আকর্ষিত হয়ে দরজায় এসে হাজির হলেন। সুভদ্রা বললেন, মাতা রোহিনীর নিষেধ রয়েছে ভেতরে যেতে। এরপর কৃষ্ণ এসে হাজির। বোনের কথায় বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে রইলেন। সুভদ্রার ডান দিকে দাদা বলরাম, বাদিকে কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেসে আসা লীলাকথা শুনতে থাকলেন। এ মধুময় প্রেমতত্ত্বের আলোচনা শ্রবণ করে তিনজন প্রেম বিগলিত হয়ে বিকলাঙ্গ হয়ে গেলেন। এ অবস্থায় দেবর্ষী নারদ এসে উপস্থিত হলেন। এ প্রেম বিগলিত স্বরূপ দর্শন করে নারদ হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, বহুদিন পরে ব্রজলীলার কথা শুনতে পেলাম।
আজ বড় আনন্দের দিন, নারদ এ অবসরে তুমি কিছু বর প্রার্থনা কর। ভক্তপ্রবর দেবর্ষী নারদ বললেন, প্রভু এ প্রেম বিগলিত স্বরূপ যেন জগতবাসী জীবের নয়ন গোচর হয় এ প্রার্থনা। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, দারুব্রহ্মস্বরূপ জগদ্বাসী অবশ্যই দেখতে পাবে এবং তোমার, শিবপার্বতীর ইচ্ছায় আমার অন্ন ব্রহ্মরূপও প্রকাশ পাবে। নীলাচল ধামে তিনটি মন্দির-গম্ভীরা মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, গু-িচা মন্দির। শ্রীকৃষ্ণ রাধাভাবে শ্রীকৃষ্ণের জন্য কেঁদেছেন স্থান গম্ভীরা, রাধার বিরহে কৃষ্ণ কেঁদেছেন স্থান জগন্নাথ মন্দির, রাধা কৃষ্ণ বিরহে কেঁদেছেন স্থান গুন্ডিচা মন্দির। রথে আরোহণ করে যাত্রা বলেই রথযাত্রা রথীহীন রথে যাত্রা নেই। তেমনি জীবনদেহও রথী শূন্য নয়। আমাদের মানবদেহে রথী আছেন দেহ থেকে রথী বিচ্ছেদ ঘটলে পৃথিবীর ভাষায় মৃত্যু। এ সত্য শুদ্ধ সত্তা আছেন বলেই জীবের দেহরথ চলে। দেহের প্রাণ নামক সত্য সত্তাই জগন্নাথ। দ্বারকায় অবস্থানকালে বৃন্দাবনের প্রেমকথা শ্রবণ করে শ্রীকৃষ্ণের বাসনা জেগেছিল একবার বৃন্দাবনে যাওয়ার। জগন্নাথ মন্দির থেকে জগন্নাথ বিগ্রহকে রথে চড়িয়ে গু-িচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া অর্থ জগন্নাথ শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনে যাত্রা। গু-িচা মন্দিরে জগন্নাথ বিগ্রহকে ৭ দিন রাখার পর পুনঃশ্রীমন্দিরে ফিরিয়ে নিয়ে আসা অর্থ আবার দ্বারকায় আসা- এটি ফিরতি রথ বা উল্টোরথ নামে খ্যাত। অন্তরে কৃষ্ণ বাইরে রাধা তিনি কলিকালে শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপে হলেন চৈতন্য মহাপ্রভু। আর অন্তরে রাধা বাইরে কৃষ্ণ হলেন জগন্নাথদেব। দু'জনের মিলন হলো লীলাচলে। ষোড়শ শতাব্দীতে মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গ সন্ন্যাস গ্রহণ করে নীলাচলে এলে জগন্নাথ মন্দিরে রথযাত্রার উৎসব বৃহত্তর আঙ্গিকে শুরু হয়, যা আজ অবধি বিশ্বে পরিব্যাপ্ত।
অনেকে মনে করেন যে, জগন্নাথদেবের মূর্তি বুদ্ধদেবেরই রূপান্তর। আবার অনেকে মনে করেন যে, জগন্নাথদেব কোনো অনার্য জাতির দেবতা। বিবর্তনের ধারায় হিন্দুদেবতা বিষ্ণু এবং সব শেষে জগন্নাথদেব হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এর পেছনে যুক্তিও আছে-স্কন্দপুরাণে উৎকলখ-ে এবং পুরষোত্তমখ-ে শবরপতি বিশ্বাসুর ছিলেন নীলগিরি পর্বতে নীলমাধবের পূজারী এবং উপাসক। পরে নীলমাধব এখান থেকে অন্তর্হিত হয়ে কাঠদ্বারা নির্মিত জগন্নাথদেবের মূর্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শবরপতি বিশ্বাসুর অনার্য জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বলেই জগন্নাথদেবকে অনার্যদের দেবতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। আবার কেউ কেউ, বৌদ্ধ ত্রিরত্মের মধ্যে সংঘ নারীরূপে বুদ্ধের ও ধর্মের মাঝখানে অবস্থান করায় জগন্নাথদেবের মূর্তি ত্রিরত্মের রূপান্তর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
স্বামী অভেদানন্দ তিব্বতের লাদাখ অঞ্চল ভ্রমণকালে 'বৌধখুর্ব' গ্রামে ত্রিরত্মের যে মূর্তি দেখেছিলেন, সেই মূর্তিগুলোকে তিনি জগন্নাথদেবের মূর্তির প্রতিরূপ বলে গণ্য করেছেন। স্বামীজীর বর্ণনা অনুসারে লামাদের একটি ত্রিরত্ম বা 'পরমেশ্বরা' রহিয়াছে। আমাদের দেশের ইট দিয়ে গাঁথা তুলসী মন্দিরের মতো ইহারা তিনটি ক্ষুদ্র নিরেট মন্দির নির্মাণ করিয়া প্রথমটিতে কালো, দ্বিতীয়টিতে হলদে ও তৃতীয়টিতে সাদা রঙ লাগাইয়া বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রতীক নির্মাণ করিয়া তাহাদের পূজারতি করেন। ইঁহারা এইগুলিকে 'পরমেশ্বরা' বলেন। 'পরমেশ্বরা' শব্দ পরমেশ্বর শব্দের অপভ্রংশ। এইগুলোতে চোখ অাঁকিয়া দিলে প্রথম কালোটিকে হস্তপদহীন জগন্নাথ, দ্বিতীয় হলদেটিকে সুভদ্রা ও তৃতীয় সাদাটিকে বলরাম মনে হয়।
উড়িষ্যার অনেক বৈষ্ণব ভক্তকবি জগন্নাথদেবকে বুদ্ধের মূর্তি বা অবতার বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস শ্রীকৃষ্ণই বুদ্ধরূপে জগন্নাথ নামে অধিষ্ঠিত। জগন্নাথ দাসের 'দারুব্রহ্ম' ও অচ্যুতানন্দ দাসের রূপান্তর 'শূন্য সংহিতা'য় এই তত্ত্ব স্থান পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ঈশ্বর দাস ও অচ্যুতানন্দ জগন্নাথদেবকে বুদ্ধের এবং শ্রীচৈতন্যদেবকেও বুদ্ধ বলে বর্ণনা করেছেন।
উৎকলখ-ের বর্ণনা অনুসারে জগন্নাথদেব শঙ্খচক্রধারী, সুতরাং দ্বিভূজ। কিন্তু প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে বিশ্বকর্মা জগন্নাথদেবের মূর্তি তৈরি করার সময় কারো প্রবেশ ছিল নিষেধ, এমনকি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নেরও না। বিশ্বকর্মা মূর্তি তৈরি করার আগেই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন অধৈর্য হয়ে বন্ধ দরজা খোলার জন্য মূর্তি অপূর্ণাঙ্গ থেকে যায়। আমরা যে রথযাত্রা উৎসব পালন করে থাকি তা জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা এবং রথযাত্রা সূর্যের অয়নপথ পরিক্রমার সাথে সংশ্লিষ্ট। সূর্যের দক্ষিণায়ন যাত্রার সঙ্গে সর্ষাগমনের সম্পর্ক স্বতঃসিদ্ধ। আর বর্ষা শুরুর উৎসব জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা। জগন্নাথদেব সূর্য-সপ্তাশ্ব বাহিত রথে আকাশলোক পরিক্রমণ করেন। তারপর রথে অরোহণ করে গু-িচা যাত্রা করেন। অয়নপথে সূর্যের দক্ষিণ দিকে যাত্রা ও উত্তরে প্রত্যাবর্তন জগন্নাথদেবের রথযাত্রা ইতিবৃত্ত।
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রথযাত্রার উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। রথযাত্রা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য মিলন মেলা। এই দিনে এখানে নানা ধর্মের-বর্ণের লোক জগন্নাথদেবের মূর্তি এক নজর দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে সমবেত হয়। জগন্নাথদেবও তার জগৎকল্যাণময় মূর্তি নিয়ে মন্দিরের পূজাবেদী হতে বেরিয়ে এসে রথারোহণে যাত্রা শুরু করেন। বছরে একবার দর্শন দিয়েও তিনি অসংখ্য ভক্তের চিত্তবিহারী হয়ে ভক্তহৃদয়ে অবস্থান করেন।
তারাপদ আচার্য্য: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ।

নিবেদনে: শ্রীমদ্ভগবদগীতা স্কুল।

No comments:

Post a Comment