Hare Krishna

Hare Krishna
Welcome to ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ

Saturday, June 24, 2017

রথযাত্রার মেলা ও তার মাহাত্ম্য

প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়। সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কাছে রথযাত্রা একটি মহৎ উৎসব। শ্রী বিষ্ণুকে ভক্তিভরে রথারোহণ সময়ে বা গমনে দর্শন করলে তাদের বিষ্ণুলোকে বাস হয়ে থাকে, এমন একটি বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই রথযাত্রা উদযাপিত হয়ে আসছে অনাদিকাল থেকে। শ্রী বিষ্ণুর এই উৎসব থেকে পরম মঙ্গলপ্রদ আর কিছুই ইহ জগতে নেই। যদিও পৃথিবীর বিভিন্নস্থানে এই উৎসব সাড়ম্বরে উৎযাপন করা হয় কিন্তু উড়িষ্যা রাজ্যের পুরী শহরের রথযাত্রা বিশ্ব বিখ্যাত। এখানে জগন্নাথদেবের মন্দির ঐতিহাসিক এবং রথযাত্রা উপলক্ষে পুরীতে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম ঘটে। এ ছাড়া রামেশ্বরম, দ্বারকা এবং বদরীনাথের রথযাত্রা বিখ্যাত। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র রথযাত্রার উৎসব পালিত হয়। তবে ধামরাই এর যশোমাধবের রথ, কুমিল্লার ত্রিপুরার মহারাজের রথ, ঢাকার স্বামীবাগে ইসকন মন্দিরের রথযাত্রা, ফরিদপুরের ওড়াকান্দি, নোয়াখালীর জমিদার হাট ইত্যাদি রথের মেলার জন্য বিখ্যাত।
রথযাত্রার মাহাত্ম্য সম্পর্কে কঠোপনিষদে বিশদভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয় যে মানুষের দেহ হচ্ছে একটি রথ, ঈশ্বর হচ্ছেন তার সারথী, যিনি এই ভবসাগর পরিভ্রমণ পরিচালনা করেন। আত্মা হচ্ছে পরিভ্রমণকারী এবং দেহ তা ধারণ করে জন্ম থেকে জন্মান্তরে বিচরণ করছে। প্রাণশক্তি, পরধর্মসহিষ্ণুতা, আত্মসংযম, দয়া, দাক্ষিণ্য, সমতা, প্রশান্তিকে ধারণ করে যেই দেহধারী সঠিক পথ ধরে পরিক্রমা করতে পারে সেই রথ ঈশ্বরের নির্ধারিত আবাসস্থলে পৌঁছতে পারে এবং তার আর পুনর্জন্ম হয় না, বিষ্ণুলোকে বা নিত্যধামে গমন করেন।
জীবন হচ্ছে এক যাত্রা, পরমাত্মা সাথে মিলনের পথে পরিভ্রমণ করছে অহর্নিশি। জীবনরথে উপবেশনকারী সকল জীবের প্রতি মুনি ঋষিগণ তাই উপদেশ দিয়েছেন সকল অহঙ্কার ও সম্পদ সমর্পণ করো পরমাত্মার কাছে, তার নিদের্শনাই হচ্ছে তোমার জীবনের পাথেয়। তবেই মহামিলনের মাধুরী আস্বাধন করতে পারবে, জীবন হবে ধন্য। এমন একটি আধ্যাত্মিক ভাবনা লালন করে রথযাত্রা উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ প্রভু জগন্নাথকে রথে আসীন অবস্থায় দর্শন করতে বা রথের রসি ধরতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জনও দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। তাদের বিশ্বাস রথে আসীন জগন্নাথ প্রভুকে দর্শন বড় প্রাপ্তি। শাস্ত্রে বলা হয়েছে রথারোহী পরমেশ্বর ভগবান শ্রীজগন্নাথকে দর্শন করলে এই জড় জগতের জন্ম মৃত্যুর আবদ্ধতা থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তি লাভ করা সম্ভব। এই জাতীয় বিশ্বাস সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরকে রথের মহৎ উৎসব পালন করা এবং রথের উপর ঈশ্বরকে দর্শন লাভে অনুপাণিত করে আসছে। রথযাত্রার এমন উৎসব চলে আসছে ৫ হাজারেরও বেশি সময় ধরে।
প্রভু জগন্নাথ হচ্ছেন জগতের অধিপতি। তিনিই হচ্ছেন পরমাত্মা পরমব্রহ্ম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরেক রূপ। তিনিই হচ্ছেন পরমপ্রভু যার উদ্দেশ্যে নিবেদিত জীব জগতে সব কিছু। তারই উদ্দেশ্যে সকল আয়োজন এবং সকল নিবেদন। তবে যে কাহিনীকে রথযাত্রার ইতিহাস হিসাবে প্রধানত বিশ্বাস করা হয় তা হচ্ছে মূলত শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবলরাম ও শ্রীমতি সুভদ্রা দেবী সূর্য গ্রহণ উপলক্ষে কুরুক্ষেত্রে স্যমন্ত পঞ্চক তীর্থে অবগাহন করতে যান। কুরুক্ষেত্রে সূর্য গ্রহণকালে পুণ্যস্নানে এখনো লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থীর সমাগম ঘটে। তেমনি এক রীতি অনুসরণ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ৫ হাজার বছর আগে দ্বারকা থেকে কুরুক্ষেত্রে গমন করেন।
এই পুণ্যস্নানে বৃন্দাবন থেকে ব্রজবাসীরাও অংশগ্রহণ করেন। স্নান সমাপন্তে ব্রজবাসীরা খবর পেলেন শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে এসেছেন এবং তারা দলে-বলে শ্রীকৃষ্ণের দর্শন লাভে হাজির হলেন। ব্রজবাসীরা বলতে শুরু করলেন ব্রজের রাখাল প্রেমময় শক্তির আধার শ্রীকৃষ্ণকে আমরা নিয়ে যাবো আমাদের মাঝে ব্রজধামে। সবাই ঠিক করলো রথের রসি ধরে তারা টানতে শুরু করবে এবং সেই রসি ধরে টানতে টানতে তারা রথে আসীন শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম আর সুভদ্রাকে নিয়ে চলে এলো ব্রজধামে। সেই সময়কে স্মরণ করেই রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে হাজার বছর ধরে। এভাবেই শুরু হয়েছে রথযাত্রার উৎসব।
প্রকৃতপক্ষে রথযাত্রা অনুষ্ঠানের ঐশ্বর্যপর ভগবদ্ভক্তিকে অতিক্রম করে মাধুর্যপর ভক্তিকে প্রদর্শন সুযোগ লাভ করে ভক্তবৃন্দ। তাই রথযাত্রার সাথে হিন্দু ধর্মীয় অন্যসব অনুষ্ঠানের কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম ধর্মী ক্রিয়াকলাপ লক্ষ্য করা যায়। আবার রথের ৭ দিন পর আসে ফিরতি রথ বা উল্টো রথ। অর্থাৎ অনুষ্ঠানটি একদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না এবং সপ্তাহব্যাপী চলে ধর্মীয় আলোচনা, গান ও কীর্তন এবং আনন্দ উৎসবের মাঝে মহাসমারোহ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জগতে দুর্দশাগ্রস্ত এবং অবহেলিত জীবদের উদ্ধার করতে লীলাময় মাধুর্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিলেন। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু দীর্ঘ ৪০ বছর নীলাচলে অবস্থান করে কৃষ্ণভক্তির জোয়ারে জগত্বাসীকে বিমোহিত করেছিলেন। জগন্নাথদেব হচ্ছেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। ভক্তদের ভাষায় 'যে গৌর সেই কৃষ্ণ সেই প্রভু জগন্নাথ'। জগন্নাথের নিকট প্রার্থনা করে অনেক বিপদগ্রস্ত মানুষ স্বর্গীয় শান্তির সন্ধান পেয়েছেন, দুর্দশা থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন।
বাংলাদেশে রথযাত্রা উপলক্ষে রথের মেলা বসে প্রায় সর্বত্র। রথের দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা তাতে যোগদান করে রথের মিছিল এবং রথ টানাকে সফল করতে সাহায্য করেন। রথের মেলা বর্তমানে একটি সার্বজনীন রূপ নিয়েছে এবং ধর্মীয় ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠে একটি মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন রথের উৎসবকে অর্থবহ করতে সার্বিক সহযোগিতা  প্রদান করেন।

No comments:

Post a Comment