১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারত এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে ভারতীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহনের মাধ্যমে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু সংস্থাগুলোর কাছে বেশ সমাদৃত হয়েছে । ইসকনের ভারতীয় সদস্যদের অনেকাংশ কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন পরিচালনায় ভূমিকা রাখছে । তারা শৈশব থেকে কৃষ্ণকে আরাধনা করে এসেছে এবং তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ইসকনের মৌলিক নীতিসমূহ (আমিষাহার, দ্যূত ক্রীড়া, অবৈধ যৌনসঙ্গ, নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ বর্জন ইত্যাদি) অনুসরণ করে এসেছে ।
এক্ষেত্রে ভারতীয়রা যে ইসকনকে সাপোর্ট দিয়েছে এ চিন্তাধারা কখনোই আমাকে কিংবা আমার নিজের কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলনে প্রভাবিত করেনি । পশ্চিমা দেশে বিশেষত, লোকেরা ইসকন ভক্তদেরকে নতুন বা অন্যরকম ধারনা বলে দেখে । কিন্তু ইসকনে হিন্দু সম্প্র্রদায়ের এ বিশাল সংখ্যক অংশগ্রহনের ব্যাপারটি আমাকে সহায়তা করে অন্যকে বোঝাতে যে, আমি এমন এক সংস্থায় যোগ দিয়েছি যেটির সুপ্রাচীন ধর্মীয় নীতি এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে এবং এর রয়েছে বিশ্বব্যাপি লক্ষ লক্ষ অনুসারী । আমি অবশ্যই সততার সাথে স্বীকার করি যে, বৈদিক সংস্কৃতি অঙ্গনে আমার অগ্রসরতা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে পিছপা হতে বাধ্য হই যখন শুনি যে, কেউ পরমেশ্বর ভগবান কৃষ্ণকে ‘হিন্দু ভগবান’ কিংবা কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনকে ‘হিন্দুত্ববাদের একটি দল’ (a sect of Hindusm) হিসেবে অথবা শ্রীমদ্ভগবদগীতা, যেটি ইসকন শতাধিক ভাষায় প্রকাশ করেছে, সেটিকে ‘দ্যা হিন্দু বাইবেল’ হিসেবে সম্বোধন করে । প্রচলিত রীতি বা সাধারণ উপলব্ধিতে হয়ত ‘হিন্দু’ বলাটা ঠিক হতে পারে । গভীরভাবে বিবেচনা করলে বোঝা যায়, এ ধরনের সম্বোধন পুরোপুরি যথাযথ নয় ।
শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বা ভারতের কোন বৈদিক শাস্ত্রে এ ‘হিন্দু’ শব্দটি খুজে পাওয়া যায় না । ‘হিন্দু’ শব্দটির আগমন ঘটে সংস্কৃত শব্দ ‘সিন্ধু’ শব্দ থেকে যার অর্থ হল ‘নদী’ এবং প্রকৃতপক্ষে যেটি ছিল একটি নদীর নাম । হিমালয়ের তিব্বত শৃঙ্গ থেকে এ নদী প্রবাহিত হয় । প্রায় দুই হাজার মাইল হয়ে আরব সাগরের দিকে যেটি বর্তমানে প্রবাহিত হচ্ছে যমুনা, কাশ্মির এবং পাকিস্তান হয়ে । বর্তমানে এ নদীকে আমরা বলে থাকি ‘ইন্দাস্’ হিসেবে । ইসকন প্রতিষ্ঠাতা এ আচার্য্য শ্রীল প্রভুপাদ ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, আফগানিস্তান, বালুচিস্তান এবং পারস্য অঞ্চলে বসবাসরত পারস্য উচ্চারণগত ত্রুটির কারণে ‘সিন্ধু’ নদীকে ‘হিন্দু’ বলত । ‘সিন্ধু’; কথাটি তারা উচ্চারণগত ত্রুটির কারণে সঠিকভাবে বলতে পারত না । ‘স’ কে ‘অ’ বা ‘হ’ – এর মতো বিকৃতভাবে উচ্চারণ করত । ‘দ’ বা ‘ধ’ কে ‘ড’ বলত । শতাব্দি ধরে গ্রীক, হুন জাতি, টারটার (Tartar) এবং মোগল সৈন্যরা ভারত দখল করার চেষ্টা করেছিল । ভারতকে আক্রমণ করার সুগম পথটি ছিল সিন্ধু নদের উপর দিয়ে । তারাই তাদের সাথে এ ‘হিন্দু’ নামটি নিয়ে এসেছিল । এভাবে হিন্দু, হিন্দুস্থান, হিন্দুইজম, হিন্দী এবং এমনকি ইন্ডিয়া নামটিও তাদেরই মাধ্যমে আগত । তাই যদি কাউকে ‘হিন্দু’ বলা হয় তবে বুঝতে হবে ইন্দাস্ নদের তীরে বসবাসরত একজন ব্যক্তি ।
কিন্তু এসমস্ত লোকেরা কি করে ? তাদের ভূমি বহিরাগতদের মাধ্যমে বারবার জয় করার পূর্বে এ সমস্ত লোকেরা কি করত অর্থাৎ তাদের পেশা কি ছিল ? এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বর্তমান পরিস্থিতি কেমন ? যাকে আমরা এখন হিন্দুত্ববাদ হিসেবে আখ্যায়িত করি তার ধর্ম, দর্শন এবং সংস্কৃতির কিংবা জাত পদ্ধিতির কিরুপ অবস্থা কি ?
শ্রীল প্রভুপাদ এর উত্তর দিয়েছিলেন যে, ভারতের প্রকৃত সংস্কৃতি প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদগীতায় স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে, যেখানে পরমেশ্বর ভগবান কৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেন যে, তিনি মানব সমাজ সৃষ্টি করেছেন ৪ টি শ্রেণী বা বর্ণে । সেগুলো হল
১) একটি বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন শ্রেণী (ব্রাহ্মণ)
২) শাসক শ্রেণী (ক্ষত্রিয়)
৩) ব্যবসায়ী শ্রেণী (বৈশ্য)
৪) শ্রমজীবি শ্রেণী (শূদ্র)
ব্যক্তিগত কার্যাবলী এবং যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে এই সমস্ত শ্রেণী কিংবা পেশাগত বিভাগ সৃষ্টি হয়েছে এবং এগুলো বর্তমানে শুধু ভারতবর্ষই নয় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে ।
এ সমস্ত শ্রেণী ছাড়াও রয়েছে ৪ টি জীবনস্তর । যেগুলো জীবনের বিভিন্ন স্তরকে নির্দেশ করে । সেগুলো হল
১) ছাত্র জীবন (ব্রহ্মাচর্য)
২) বৈবাহিক জীবন (গৃহস্থ)
৩) অবসর জীবন (বানপ্রস্থ)
৪) ত্যাগ স্তরের জীবন (সন্ন্যাস)
এগুলোও মানব সমাজে কিছু ক্ষেত্রে দৃশ্যমান । জীবনের প্রথম ভাগ শিক্ষার জন্য পরে বৈবাহিক জীবনে প্রবেশ এবং চাকুরী, ব্যবসা । তারপর ৫৫-৬০ বছরের বয়সের মধ্যে অবসর গ্রহণ । কিন্তু ত্যাগের স্তরটি বিশ্বে খুব একটা দৃশ্যমান নয় । যদিও কিছু ধার্মিক নারী পুরুষকে এটি করতে দেখা যায় ।
এ সমগ্র পদ্ধতিকে বলা হয় বর্ণাশ্রম ধর্ম । এ বর্ণাশ্রম পদ্ধতিতে যার যার নিজস্ব দায়িত্ব কর্তব্যের উদ্দেশ্য হল পরমেশ্বর ভগবানকে সেবা এবং সন্তুষ্ট করা । পরমেশ্বর ভগবানের সেবাকেই বলা হয় সনাতন ধর্ম । এ সনাতন ধর্ম হল প্রতিটি জীবের কর্তব্য এবং সাধারণ কার্য । এ সনাতন ধর্ম বিশ্বের সমস্ত ধর্মকে এক সুতোতে আবদ্ধ করেছে ।
শ্রীমদ্ভাগবতের ১/২/১৩ – এ পরমেশ্বর ভগবানের উদ্দেশ্যে কর্ম করে সিদ্ধি অর্জনের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে । গীতাতেও পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজে ব্যাখ্যা করেন যে, সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের উদ্দেশ্য হল তাকে জানা । এ বিষয়টি আরো সরল করেন ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শিক্ষা দিয়েছেন যে, যেহেতু এই যুগে বৈদিক প্রদত্ত পদ্ধতি প্রকৃতভাবে অনুসরণ করা প্রায় অসম্ভব হতে পারে । তাই সমস্ত শ্রেণীর লোকের উচিত ভগবানের পবিত্র নাম নিয়মিত জপ করার মাধ্যমে এবং তাদের কর্মের ফল উৎসর্গ করার মাধ্যমে ভগবানকে সন্তুষ্ট করা ।
ভারতীয় জাতি বা বর্ণ পদ্ধতি হল বর্ণাশ্রম ধর্মের একটি বিকৃত রুপ । কারণ এখন জাতি নির্ধারিত হয় জন্মের মাধ্যমে, কার্যাবলী মাধ্যমে নয় । কারো জন্ম দ্বারা জাতি নির্ধারন বৈদিক শাস্ত্র স্বীকার করে না । কোনো জজের পুত্র কি আপনাআপনিই আদালতে বসার অনুমোদন পাবে ? ডাক্তারের পুত্র কি মেডিকেলে না পড়ে ডাক্তারী করতে পারবে ? অবশ্যই না ।
অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে প্রকৃত বর্ণাশ্রম পদ্ধতি এবং হিন্দুত্ববাদের মধ্যে তা হল হিন্দুত্ববাদের কোন প্রকৃত লক্ষ্য বা উপসংহার নেই । হিন্দুত্ববাদ পরমেশ্বর ভগবান এবং সহযোগী দেব-দেবী উভয়ের পূজা স্বতসিদ্ধ করে ।
অতএব, প্রশ্ন, ইসকন কি হিন্দুত্ববাদের কি একটি অংশ ? হ্যাঁ নাকি না আপনিই সিধান্ত নিন ।
তবে এটুকু পরিষ্কার যে, যদিও হিন্দুত্ববাদ একটি অন্যপ্রান্ত থেকে আগত বিষয় । যা বৈদিক বর্ণাশ্রম প্রথার অপব্যবহার, ভুল উপলব্ধি ইত্যাদি প্রকাশিত করেছে । ইসকন ইন্দাস্ এর উভয় পার্শ্বে সেই হারানো বর্ণাশ্রমকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছে যাতে করে উভয় প্রান্তের লোকেদের মধ্যে ভগবৎ চেতনা জাগরিত হয় ।
পরিশেষে, উপরে বিস্তৃত আলোচনা থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, আমরা হিন্দু নয়, আমরা আর্য (যারা জীবনের মূল্য বোঝে)। আমাদের প্রকৃত ধর্মের নামই হল সনাতন ধর্ম । আর এ বৈদিক শাস্ত্রে মতাদর্শ অনুসারে আমাদের একটি মাত্র কর্তব্য হল পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি বিধান করা । শ্রীমদ্ভগবদগীতা এবং ভাগবত পুরানে বৈষ্ণবদর্শন সমস্ত ধর্মের জন্য একটি সরল নীতি শিক্ষা দেয় । যাকে সনাতন ধর্ম বলা হয় অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি প্রেম ভক্তিমূলক সেবা ।
“সুশান্ত বান্দা”
No comments:
Post a Comment