সাক্ষাৎকারী: কৃষ্ণভাবনামৃত আস্বাদনের অনুশীলনে নামতে হলে কোনও পরীক্ষাধীন স্তর অতিক্রম করতে হয়, না কি, যে-যার চিন্তা-ভাবনার বিকাশ অনুসারেই জ্ঞান-উপলব্ধি অর্জন করতে পারে?
শ্রীল প্রভুপাদ: হ্যাঁ, সব কিছুতেই উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকা চাই বৈকি! যেমন, একটা ছেলে কোনও উৎসাহ-উদ্দীপনা ছাড়াই স্কুলে যাচ্ছে, আর একটি ছেলে বেশ উৎসাহের সঙ্গেই স্কুলে রোজ যাচ্ছে। একটি ছেলে পরীক্ষায় প্রথম হচ্ছে, অন্য ছেলেটি ব্যর্থ হচ্ছে কিংবা ক্লাশে সবার নিচে থাকছে। তাই আমি আগেও বলেছি পরীক্ষাধীন সময়- কৃষ্ণভাবনা অনুশীলনের ক্ষেত্রেও উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকা চাই। মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনার ওপরেই তার উন্নতি বা বিকাশের সম্ভাবনা নির্ভর করে থাকে। কে কতটা গুরুত্ব দিয়ে শিখছে। প্রত্যেককে বেশ গুরুত্ব সহকারে শিখতে হয় সব কিছু। সিদ্ধি সাফল্যের ক্ষেত্রে সর্বত্রই এই নিয়ম। সুতরাং কৃষ্ণভাবনা অনুশীলনের ক্ষেত্রে সার্থক সিদ্ধিলাভের জন্য খুব বেশি উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকা চাই। হ্যাঁ, তা ছাড়া উন্নতি সম্ভব নয়। জীবনের সকল ক্ষেত্রেই সেই একই কথা। আর মানুষকে ধীরস্থির হতে হবে। ধৈর্য ধারণ করে সিদ্ধিলাভের জন্য প্রতীক্ষা করে থাকতে হবে। উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকার মানে এই নয় যে, আমি এখনই কোনও বিষয়ে উৎসাহ নিয়ে কাজে লাগি তো এখনি তার সুফল হাতেনাতে পেয়ে যাব। না। ফল লাভে দেরি হতেই পারে। কিন্তু তা হলে আমাদের বিচলিত হওয়া চলবে না। তা সত্ত্বেও সমানভাবে উৎসাহ আর উদ্দীপনা বজায় রেখে আমাদের কাজ করে চলতে হবে। একেই বলা হয় ধৈর্য, অধ্যবসায়। উৎসাহ, উদ্দীপনা, ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং আত্মবিশ্বাস, নিজের ওপরে ভরসা। যেহেতু, আমরা শ্রীকৃষ্ণে বিশ্বাস রেখে চলি, তাই জানি, শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, তুমি এই কাজটি করলে এই ফল লাভ করবে। অতএব আমার নিজের ওপরে ভরসা থাকা চাই। ঠিক যেমন শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, শুধুমাত্র তাঁকে উপলব্ধির মাধ্যমে, তিনি কে, কিভাবে তিনি এলেন, কিভাবে চলেন, এই সমস্ত উপলব্ধির দ্বারা অচিরেই মানুষ তাঁর চিন্ময় ধামে প্রবেশ লাভের পাসপোর্ট পেয়ে যেতে পারে। অতএব ভগবদ্ধামে, আমাদের নিজধামে ফিরে যেতেই হবে এইভাবে। এটাই হল আত্মবিশ্বাস। সুতরাং উৎসাহ-উদ্দীপনা, ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস। আর……উৎসাহাৎ নিশ্চয়াদ্…….তৎ তৎ কর্ম প্রবর্তনাৎ। শুধু চাই উদ্দীপনা, আর কোনও কিছু নয়। তবে কৃষ্ণভাবনাময় নির্ধারিত কর্তব্যকর্মে লেগে থাকাও চাই। আর সকল সময়ে ভক্তদের সান্নিধ্যে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে হবে। আমি বলতে চাই, এই জিনিসগুলিই কৃষ্ণভাবনামৃত আস্বাদনের পথে প্রেরণা জাগায়। অতএব, যতই বেশি করে এই ছয়টি নীতি মেনে চলার ব্যাপারে নিজেকে অনুপ্রাণিত করে রাখা যাবে- ধৈর্য, উৎসাহ-উদ্দীপনা, তার পরে আত্মবিশ্বাস, তার পরে ভক্তিমূলক কাজকর্মে আত্মনিয়োগ করে থাকা, ভক্তদের সঙ্গ-সান্নিধ্য লাভ করা আর অভক্তদের সঙ্গ বর্জন করা- ততই লাভ। এটাও একটা মনে রাখার মতো ব্যাপার। ঠিক যেমন আগুন জ্বালাতে হলে, কাঠ যত শুকনো হবে, তত ভাল আগুন পাওয়া যাবে। যদি ভিজে কাঠ আনা হয় তো জ্বলতে খুব কষ্ট। তাই অভক্তদের সান্নিধ্যে গিয়ে ভিজে না যাই, সেদিকে খেয়াল রেখে, নিজেদের শুকনো অর্থাৎ শুদ্ধ রাখতে হবে। এটাও একটা পন্থা। এদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। যদি আপনারা গীতা-ভাগবতের ক্লাসে আসেন, আর অন্য সব ক্লাসেও যান, কোনও নাইট ক্লাবের আড্ডায় যান, তা হলে তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া হয়ে সব বরবাদ হয়ে যাবে। বুঝেছেন? অতএব এটা করতেই হবে- যদি আপনি আগুন জ্বালাতে চান ঠিকমতো, তা হলে জল থেকে সেটিকে বাঁচাতেই হবে। আর যদি আগুন জ্বালিয়ে তাতে জল ঢালেন, তা হলে কি লাভ হল? কিছুই না। সুতরাং, কৃষ্ণভাবনা অনুশীলনে উন্নতি লাভ করতে হলে অভক্তদের সঙ্গে আপনাদের সান্নিধ্য বর্জন করতে হবে। এই ছয়টি নিয়মনীতি মেনে চলতে পারলে তবেই কৃষ্ণভাবনামৃতের প্রকৃত আস্বাদন-মাধুর্য লাভ করা সম্ভব হবে।
সাক্ষাৎকারী: কর্মজীবনের কাজের মধ্যে যে-বিশ্বাস সক্রিয় থাকে তার মধ্যে কৃষ্ণভাবনার ভূমিকা কিছু থাকে কি?
শ্রীল প্রভুপাদ: হ্যাঁ, থাকে। কৃষ্ণভাবনাময় কাজকর্ম আপাতদৃষ্টিতে কর্মজীবনের মতো কাজের ধারা বলেই বোধ হয়। বুঝতে হবে কর্ম আর ভক্তির মাঝে পার্থক্যটা কি? যেমন, আমরা এই টেপ রেকর্ডার, এই মাইক্রোফোন ব্যবহার করছি। কোনও রাজনৈতিক নেতার কাছে গেলেও আপনারা একই সামগ্রী দেখতে পাবেন। আমিও এই সবের মাধ্যমে কথা বলছি, তিনিও দেখা-সাক্ষাতের সময় এতেই কথা বলছেন। তা হলে আপাতদৃষ্টিতে আমরা সবাই সমান। কিন্তু এটা হল ভক্তি আর ওটা হল কর্ম। ভক্তি আর কর্মের মাঝে কিসের তফাৎ? কর্ম মানে আপনি কিছু করছেন এবং আপনি যা কিছুই করছেন, তার একটা ফল হচ্ছে। অতএব, ফলটাও আপনি গ্রহণ করছেন। মনে করুন, আপনি কোনও ব্যবসা করেন। তা থেকে লক্ষ টাকা লাভ হল। তা হলে সেটা আপনি নিলেন। আর তা থেকে লক্ষ টাকা লোকসান হল। আপনি লোকসান মেনে নিলেন। এই হচ্ছে কর্ম। নিজের হিসাব মতো কাজ করছেন আর তার ফল পাচ্ছেন। পরিষ্কার হল? একে বলে কর্ম। কিন্তু আমাদের কাজকর্ম হল শ্রীকৃষ্ণের সেবার উদ্দেশ্যে। তাই আমরা কাজ করি। কোনও লাভ হলে সেটা কৃষ্ণের। কোনও লোকসান হলে, সেটা কৃষ্ণের। আমাদের কিছুই হয় না। আমরা কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের জন্য কাজ করে চলেছি। কেউ যদি আসেন তো তিনি কৃষ্ণেরই, আমার নন। এই সব ছেলেরা আমার সেবা করছে, আমার ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির জন্যে নয়, এরা কাজ করছে কৃষ্ণভাবনার অনুশীলন বাড়িয়ে তোলার জন্য। এই সব কথা ভগবদ্গীতায় চমৎকারভাবে বোঝানো হয়েছে। ভাগবতেও বোঝানো হয়েছে। কৃষ্ণসেবার পরিকল্পনাটি খুবই বিরাট। মানুষকে এটা বোঝাবার চেষ্টা করতে হবে। কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনটা কোনও অন্ধ বিশ্বাসের ব্যাপার নয়। আমাদের পদ্ধতি অবশ্য খুবই সহজ-সরল। আমরা ছোট-বড় সকলকে বলি, “এসো বসো, হরেকৃষ্ণ নাম জপ কর।” ক্রমে মানুষ বুঝতে পারে। এই বিষয়ে পড়াশুনা করতে থাকে। শিক্ষিত না হলেও কেবল কৃষ্ণনাম জপ করার মাধ্যমেও সেই তত্ত্ব ক্রমে উপলব্ধি হতে পারে। কত সুন্দর পন্থা! এই পন্থা বিদ্বানের জন্যেও যা, বাচ্চা শিশুর জন্যেও তাই।
No comments:
Post a Comment